Skip to content

কুরআন মজীদ সূরা আল বাকারা আয়াত ১২৪

Qur'an Surah Al-Baqarah Verse 124

আল বাকারা [২]: ১২৪ ~ শব্দ অনুবাদ দ্বারা শব্দ

۞ وَاِذِ ابْتَلٰٓى اِبْرٰهٖمَ رَبُّهٗ بِكَلِمٰتٍ فَاَتَمَّهُنَّ ۗ قَالَ اِنِّيْ جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ اِمَامًا ۗ قَالَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِيْ ۗ قَالَ لَا يَنَالُ عَهْدِى الظّٰلِمِيْنَ (البقرة : ٢)

wa-idhi
وَإِذِ
And when
এবং (স্মরণ করো) যখন
ib'talā
ٱبْتَلَىٰٓ
tried
পরীক্ষা করেছিলেন
ib'rāhīma
إِبْرَٰهِۦمَ
Ibrahim
ইবরাহীমকে
rabbuhu
رَبُّهُۥ
his Lord
তার রব
bikalimātin
بِكَلِمَٰتٍ
with words
কয়েকটা কথা দ্বারা
fa-atammahunna
فَأَتَمَّهُنَّۖ
and he fulfilled them
সে অতঃপর সেগুলো পূর্ণ করল
qāla
قَالَ
He said
(আল্লাহ্‌) বললেন
innī
إِنِّى
"Indeed I
''নিশ্চয়ই আমি
jāʿiluka
جَاعِلُكَ
(am) the One to make you
তোমাকে নিয়োগ করব
lilnnāsi
لِلنَّاسِ
for the mankind
মানুষের জন্য
imāman
إِمَامًاۖ
a leader"
নেতা হিসাবে''
qāla
قَالَ
He said
সে বলল
wamin
وَمِن
"And from
''এবং থেকেও
dhurriyyatī
ذُرِّيَّتِىۖ
my offspring?"
আমার বংশধরদের''
qāla
قَالَ
He said
(আল্লাহ্‌) বললেন
لَا
"(Does) not
''না
yanālu
يَنَالُ
reach
প্রযোজ্য হবে
ʿahdī
عَهْدِى
My Covenant
আমার প্রতিশ্রুতি
l-ẓālimīna
ٱلظَّٰلِمِينَ
(to) the wrongdoers"
সীমালঙ্ঘনকারীদের (জন্য)''

Transliteration:

Wa izib talaaa Ibraaheema Rabbuho bi Kalimaatin fa atammahunna qaala Innee jaa'iluka linnaasi Imaaman qaala wa min zurriyyatee qaala laa yanaalu 'ahdiz zaalimeen (QS. al-Baq̈arah:124)

English Sahih International:

And [mention, O Muhammad], when Abraham was tried by his Lord with words [i.e., commands] and he fulfilled them. [Allah] said, "Indeed, I will make you a leader for the people." [Abraham] said, "And of my descendants?" [Allah] said, "My covenant does not include the wrongdoers." (QS. Al-Baqarah, Ayah ১২৪)

তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):

এবং স্মরণ কর যখন ইবরাহীমকে তার প্রতিপালক কতিপয় বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর সে সেগুলো পূর্ণ করল, তখন আল্লাহ বললেন, ‘আমি তোমাকে মানবজাতির নেতা করছি’। ইব্রাহীম আরয করল, ‘আর আমার বংশধর হতেও’? নির্দেশ হল, আমার অঙ্গীকারের মধ্যে যালিমরা শামিল নয়। (আল বাকারা, আয়াত ১২৪)

Tafsir Ahsanul Bayaan

যখন ইব্রাহীমকে তার প্রতিপালক কয়েকটি (নির্দেশ) বাক্য দ্বারা পরীক্ষা করেছিলেন, [১] সুতরাং সে তা পূর্ণ (রূপে পালন) করেছিল। তিনি বললেন, ‘আমি তোমাকে মানব-জাতির নেতা করব।’ সে বলল, ‘আমার বংশধরগণের মধ্য হতেও?’ [২] তিনি বললেন, ‘আমার প্রতিশ্রুতি সীমালংঘনকারীদের প্রতি প্রযোজ্য নয়?’

[১] كَلِمَات (কয়েকটি বাক্য) বলতে শরীয়তের বিধি-বিধান, হজ্জের নিয়ম-পদ্ধতি, পুত্র যবেহ, হিজরত এবং নমরূদের আগুন ইত্যাদি সহ সেই সমস্ত পরীক্ষা, যার সম্মুখীন ইবরাহীম (আঃ) হয়েছিলেন এবং তিনি তাতে সফলকামও হয়েছিলেন। আর এরই বিনিময়ে তাঁকে 'ইমামুন্নাস' (জননেতা) সম্মানে সম্মানিত করা হয়েছে। তাই কেবল মুসলিমই নয়, বরং ইয়াহুদী, খ্রিষ্টান এমনকি আরবের মুশরকিরদের মাঝেও তাঁর ব্যক্তিত্ব বড়ই মর্যাদাপূর্ণ এবং তাঁকে সকলের নেতা মানা ও জানা হয়।

[২] মহান আল্লাহ ইবরাহীম (আঃ)-এর উক্ত আশা পূর্ণ করেন, যার উল্লেখ কুরআন মাজীদেই রয়েছে। {وَجَعَلْنَا فِي ذُرِّيَّتِهِ النُّبُوَّةَ وَالْكِتَابَ} অর্থাৎ, "আমি তাঁর বংশধরদের মধ্যে নবুঅত ও কিতাব রাখলাম।" (সূরা আনকাবূত ২৯;২৭ আয়াত) কাজেই যে নবীই আল্লাহ প্রেরণ করেছেন, ইবরাহীম (আঃ)-এর সন্তানদের মধ্য থেকেই করেছেন এবং তাঁর পর যে কিতাবই তিনি নাযিল করেছেন, তাও তাঁর সন্তানের মধ্য থেকেই কারো উপর নাযিল করেছেন। (ইবনে কাসীর) তারপর 'আমার প্রতিশ্রুতি সীমালংঘনকারীদের প্রতি প্রযোজ্য নয়' বলে যে বিষয়টি পরিষ্কার করে দেন তা হল এই যে, ইবরাহীম (আঃ)-এর ব্যক্তিত্ব এত উচ্চ এবং আল্লাহর নিকট তাঁর এত বড় মর্যাদা থাকা সত্ত্বেও তাঁর সন্তানাদির মধ্যে যারা অযোগ্য, যালিম ও মুশরিক হবে, তাদেরকে হতভাগ্য ও বঞ্চিত হওয়া থেকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না। কেউ নবী বংশে জন্মগ্রহণ করলেই যে তার কোন গুরুত্ব থাকবে এখানে সে ধারণার মূল আল্লাহ কেটে দিয়েছেন। যদি ঈমান ও নেক আমল না থাকে, তাহলে পীরের বেটা ও রাজার বেটা হলেও আল্লাহর নিকট তার কি কোন মূল্য থাকবে? নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, " ((وَمَنْ بَطَّأَ بِهِ عَمَلُهُ لَمْ يُسْرِعْ بِهِ نَسَبُهُ )) "যার আমল তাকে পিছিয়ে দেয়, তার বংশমর্যাদা তাকে এগিয়ে দিতে পারবে না।"

(মুসলিম, অধ্যায়ঃ যিকর ও দু'আ, পরিচ্ছেদঃ তেলাওয়াতে কুরআনের জন্য একত্রিত হওয়ার ফযীলত)

Tafsir Abu Bakr Zakaria

আর স্মরণ করুন, যখন ইবরাহীমকে তাঁর রব কয়েকটি কথা দ্বারা পরীক্ষা করেছিলেন [১], অতঃপর তিনি সেগুলো পূর্ণ করেছিলেন। আল্লাহ্‌ বললেন, ‘নিশ্চয় আমি আপনাকে মানুষের ইমাম বানাবো’ [২]। তিনি বললেন, ‘আমার বংশধরদের মধ্য থেকেও?’ (আল্লাহ্‌) বললেন, আমার প্রতিশ্রুতি যালিমদেরকে পাবে না [৩]।

[১] যে যে বিষয়ে পরীক্ষা নেয়া হয়েছে সে সম্পর্কে কুরআনে শুধু (كَلِمَات) (বাক্যসমূহ) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর ব্যাখ্যা প্রসংগে সাহাবী ও তাবেয়ীদের বিভিন্ন উক্তি বর্ণিত আছে। কেউ আল্লাহ্‌র বিধানসমূহের মধ্য থেকে দশটি, কেউ ত্রিশটি এবং কেউ কমবেশী অন্য বিষয় উল্লেখ করেছেন। বাস্তব ক্ষেত্রে এতে কোন বিরোধ নেই, বরং সবগুলোই ছিল ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম-এর পরীক্ষার বিষয়বস্তু। প্রখ্যাত তাফসীরকারক ইবনে-জরীর ও ইবনে কাসীরের অভিমত তাই। এ ধরনের পরীক্ষার বিষয়বস্তুর মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এইঃ আল্লাহ্‌ তা'আলার ইচ্ছা ছিল ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম-কে স্বীয় বন্ধুত্বের বিশেষ মুল্যবান পোষাক উপহার দেয়া। তাই তাকে বিভিন্ন রকমের কঠোর পরীক্ষার সম্মুখীন করা হয়। সমগ্র জাতি, এমনকি তার আপন পরিবারের সবাই মূর্তি পূজায় লিপ্ত ছিল। সবার বিশ্বাস ও রীতি-নীতির বিপরীত একটি সনাতন দ্বীন তাকে দেয়া হয়। জাতিকে এ দ্বীনের দিকে আহবান জানানোর গুরুদায়িত্ব তার কাধে অর্পণ করা হয়। তিনি নবীসুলভ দৃঢ়তা ও সাহসিকতার মাধ্যমে নিৰ্ভয়ে জাতিকে এক আল্লাহ্‌র দিকে আহবান জানান। বিভিন্ন পন্থায় তিনি মূর্তিপূজার নিন্দা ও কুৎসা প্রচার করেন। প্রকৃতপক্ষে কার্যক্ষেত্রে তিনি মূর্তিসমূহের বিরুদ্ধে জিহাদ করেন। ফলে সমগ্র জাতি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে উদ্যত হয়। বাদশাহ নমরূদ ও তার পরিবারবর্গ তাকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার সিদ্ধান্ত নেয়। আল্লাহ্‌র খলীল প্রভুর সন্তুষ্টির জন্য এসব বিপদাপদ সত্ত্বেও হাসিমুখে নিজেকে আগুনে নিক্ষেপের জন্য পেশ করেন। অতঃপর আল্লাহ্‌ তা'আলা স্বীয় বন্ধুকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে দেখে আগুনকে নির্দেশ প্রদান করলেন, ‘হে আগুন! ইবরাহীমের উপর সুশীতল ও নিরাপত্তার কারণ হয়ে যাও। [সূরা আল-আম্বিয়া ৬৯]

এ পরীক্ষা শেষ হলে জন্মভূমি ত্যাগ করে সিরিয়ায় হিজরত করার পর দ্বিতীয় পরীক্ষা নেয়া হয়। ইবরাহীম ‘আলাইহিস্‌ সালাম আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি লাভের আশায় স্বগোত্র জন্মভূমিকেও হাসিমুখে ত্যাগ করে পরিবার-পরিজনসহ সিরিয়ায় হিজরত করলেন। সিরিয়ায় অবস্থান শুরু করতেই নির্দেশ এল, স্ত্রী হাজেরা ও তার দুগ্ধপোষ্য শিশু ইসমাঈল '‘আলাইহিস সালাম-কে সংগে নিয়ে এখান থেকেও স্থানান্তরে গমন করুন। [ইবনে কাসীর] জিবরীল '‘আলাইহিস সালাম আসলেন এবং তাদের সাথে নিয়ে রওয়ানা হলেন। চলতে চলতে যখন শুস্ক পাহাড় ও উত্তপ্ত বালুকাময় প্রান্তর এসে গেল (যেখানে ভবিষ্যতে বায়তুল্লাহ নিৰ্মাণ ও মক্কা নগরী আবাদ করা লক্ষ্য ছিল), তখন সেখানেই তাদেরকে থামিয়ে দেয়া হল। আল্লাহ্‌র বন্ধু তার রবের ভালবাসায় এ জনশূন্য তৃণলতাহীন প্রান্তরেই তাদের থাকতে বললেন। কিন্তু পরীক্ষার এখানেই শেষ হলো না। অতঃপর ইবরাহীম '‘আলাইহিস সালাম নির্দেশ পেলেন যে, স্ত্রী হাজেরা ও শিশুকে এখানে রেখে নিজে সিরিয়ায় ফিরে যান। আল্লাহ্‌র বন্ধু নির্দেশ পাওয়া মাত্রই তা পালন করতে তৎপর হলেন এবং সিরিয়ার দিকে রওয়ানা হয়ে গেলেন। আল্লাহ্‌র নির্দেশ মোতাবেক আমি চলে যাচ্ছি - স্ত্রীকে একটুকু কথা বলে যাওয়ার দেরীও তিনি সহ্য করতে পারলেন না। হাজেরা তাকে চলে যেতে দেখে বললেন, আপনি কি আল্লাহ্‌র কোন নির্দেশ পেয়েছেন? ইবারাহীম ‘আলাইহিস সালাম বললেন, ‘হ্যা’। আল্লাহ্‌র নির্দেশের কথা জানতে পেরে হাজেরা বললেন, যান, যে প্রভূ আপনাকে চলে যেতে বলেছেন, তিনি আমাদের ধ্বংস হতে দেবেন না। [বুখারী ৩৩৬৪]

অতঃপর হাজেরা দুগ্ধপোষ্য শিশুকে নিয়ে জন-মানবহীন প্রান্তরে কালাতিপাত করতে থাকেন। সাথের সংরক্ষিত পানি ফুরিয়ে যাওয়ায় এক সময় দারুন পিপাসা তাকে পানির খোঁজে বের হতে বাধ্য করল। তিনি শিশুকে উন্মুক্ত প্রান্তরে রেখে সাফা’ ও ‘মারওয়া পাহাড়ে বার বার উঠা-নামা করতে লাগলেন। কিন্তু কোথাও পানির চিহ্নমাত্র দেখলেন না এবং এমন কোন মানুষও দৃষ্টিগোচর হলো না, যার কাছ থেকে কিছু তথ্য জানতে পারেন। সাতবার ছুটোছুটি করে তিনি নিরাশ হয়ে শিশুর কাছে ফিরে এলেন। এ ঘটনাকে স্মরণীয় করার উদ্দেশ্যেই সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মাঝখানে সাতবার দৌড়ানো কেয়ামত পর্যন্ত ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য হজের বিধি-বিধানে অত্যাবশ্যকীয় করা হয়েছে। হাজেরা যখন নিরাশ হয়ে শিশুর কাছে ফিরে এলেন, তখন আল্লাহ্‌র রহমত নাযিল হল। জিবরাঈল ‘আলাইহিস সালাম আগমন করলেন এবং শুস্ক মরুভূমিতে পানির একটি ঝর্ণাধারা বইয়ে দিলেন। [বুখারী ৩৩৬৫]

বর্তমানে এ ধারার নামই যমযম। পানির সন্ধান পেয়ে প্রথমে জীব-জন্তু আগমন করল। জীব-জন্তু দেখে মানুষ এসে সেখানে আস্তানা গাড়ল। এভাবে মক্কায় জনপদের ভিত্তি রচিত হয়ে গেল। জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় কিছু আসবাব পত্ৰও সংগৃহীত হল।

ইসমাঈল ‘আলাইহিস সালাম নামে খ্যাত এই সদ্যজাত শিশু লালিত-পালিত হয়ে কাজ-কর্মের উপযুক্ত হয়ে গেল। ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম আল্লাহ্‌র ইংগিতে মাঝে মাঝে এসে স্ত্রী হাজেরা ও শিশুকে দেখে যেতেন। এ সময় আল্লাহ্‌ তা'আলা স্বীয় বন্ধুর তৃতীয় পরীক্ষা নিতে চাইলেন। বালক ইসমাঈল অসহায় ও দীন-হীন অবস্থায় বড় হয়েছিলেন এবং পিতার স্নেহ-বাৎসল্য থেকেও বঞ্চিত ছিলেন। কুরআনে বলা হয়েছেঃ “বালক যখন পিতার কাজে কিছু সাহায্য করার যোগ্য হয়ে উঠল, তখন ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম তাকে বললেন, হে বৎস! আমি স্বপ্নে তোমাকে জবাই করতে দেখেছি। এখন বল, তোমার কি অভিপ্রায়? পিতৃভক্ত বালক বলল, পিতা! আপনি যে আদেশ পেয়েছেন, তা পালন করুন। আপনি আমাকেও ইনশাআল্লাহ্‌ এ ব্যাপারে ধৈর্যশীল পাবেন”। [সূরা আস-সাফফাতঃ ১০২]

এর পরবর্তী ঘটনা সবার জানা আছে যে, ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম পুত্রকে জবাই করার উদ্দেশ্যে মিনা প্রান্তরে নিয়ে গেলেন। অতঃপর আল্লাহ্‌র আদেশ পালনে নিজের পক্ষ থেকে যা করণীয় ছিল, তা পুরোপুরিই সম্পন্ন করলেন। ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম যখন এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন, তখন আল্লাহ্‌ তা'আলা জান্নাত থেকে এর পরিপূরক নাযিল করে তা কুরবানী করার আদেশ দিলেন। এই রীতিটিই পরে ভবিষ্যতের জন্য একটি চিরন্তন রীতিতে পরিণতি লাভ করে। [তাফসীরে ইবনে কাসীর]

এগুলো ছিল বড়ই কঠিন পরীক্ষা, যার সম্মুখীন খলীলুল্লাহ ‘আলাইহিস সালাম-কে করা হয়। এর সাথে সাথেই আরও অনেকগুলো কাজ এবং বিধিবিধানের বাধ্যবাধকতাও তার উপর আরোপ করা হল। তন্মধ্যে দশটি কাজ 'খাসায়েলে ফিতরাত’ বা প্রকৃতিসুলভ অনুষ্ঠান নামে অভিহিত। এগুলো হলো শারীরিক পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কিত, ভবিষ্যত উম্মতের জন্যও এগুলো স্থায়ী বিধি-বিধানে পরিণত হয়েছে। সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার উম্মতকে এসব বিধি-বিধান পালনের জোর তাকিদ দিয়েছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, সমস্ত ইসলাম ত্রিশটি অংশে সীমাবদ্ধ। তন্মধ্যে দশটি সূরা আল-বারাআতে, দশটি সূরা আল-মুমিনুনে এবং দশটি সূরা আল-আহ্‌যাবে বর্ণিত হয়েছে। [ইবনে কাসীর] ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম এগুলো পূর্ণরূপে পালন করেছেন এবং সব পরীক্ষায়ই উত্তীর্ণ হয়েছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমার উপরোদ্ধৃত উক্তির দ্বারা বুঝা গেল যে, মুসলিমদের জন্য যেসব জ্ঞান এবং কর্মগত ও নৈতিক গুণ অর্জন করা দরকার, তার সবই এ তিনটি সূরার কয়েকটি আয়াতে সন্নিবেশিত হয়েছে। এগুলোই কুরআনে উল্লেখিত (كَلِمَات) যেসব বিষয়ে খলীলুল্লাহ্ ‘আলাইহিস সালাম-এর পরীক্ষা নেয়া হয়েছে বলে বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে।

[২] এ আয়াত দ্বারা একদিকে বুঝা গেল যে, ইবরাহীম '‘আলাইহিস সালাম-কে সাফল্যের প্রতিদানে মাবনসমাজের নেতৃত্ব দেয়া হয়েছে, অপরদিকে মানব সমাজের নেতা হওয়ার জন্য যে পরীক্ষা দরকার, তা পার্থিব পাঠশালা বা বিদ্যালয়ের পরীক্ষার অনুরূপ নয়। পার্থিব পাঠশালাসমূহের পরীক্ষায় কতিপয় বিষয়ে তথ্যানুসন্ধান ও চুলচেরা বিশ্লেষণকেই সাফল্যের মাপকাঠি বিবেচনা করা হয়। কিন্তু নেতৃত্ব লাভের পরীক্ষায় সূরা আল-বারাআত বা আত-তাওবার ১১২ নং আয়াত, সূরা আল-মুমিনূন এর ১-১১ এবং সূরা আল-আহযাবের ৩৫ নং আয়াতে বর্ণিত ত্রিশটি নৈতিক ও কর্মগত গুণে পুরোপুরি গুনাম্বিত হওয়া শর্ত। কুরআনের অন্য এক জায়গায় এ বিষয়টি এভাবে বর্ণিত হয়েছে, “যখন তারা সবর করলো এবং আমার নিদর্শনাবলীতে নিশ্চিত বিশ্বাসী হল, তখন আমরা তাদেরকে নেতা করে দিলাম, যাতে আমার নির্দেশ অনুযায়ী মানুষকে পথ প্রদর্শন করে”। [সূরা আস-সাজদাহ;২৪] এই আয়াতে বর্ণিত (صَبر) হলো শিক্ষাগত ও বিশ্বাসগত পূর্ণতা। আর (يَقِيْن) হলো কর্মগত ও নৈতিক পূর্ণতা। কারও মধ্যে এগুলোর পূর্ণতার ভিত্তিতেই নেতৃত্বের জন্য আল্লাহ্‌র কাছে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হন।

[৩] আল্লাহ্ তা'আলা কর্তৃক নবী ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম-এর বিভিন্ন পরীক্ষা, তাতে তার সাফল্য এবং পুরস্কার ও প্রতিদানের বিষয় বর্ণিত হয়েছে। ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম যখন স্নেহ পরবশ হয়ে স্বীয় সন্তান-সন্ততির জন্যেও এ পুরস্কারের প্রার্থনা জানালেন, তখন পুরস্কার লাভের জন্য একটি নিয়ম-নীতিও বলে দেয়া হল। এতে খলীলুল্লাহর প্রার্থনাকে শর্তসাপেক্ষে মঞ্জুর করে বলা হয়েছে যে, আপনার বংশধরগণও এই পুরস্কার পাবে, তবে তাদের মধ্যে যারা অবাধ্য ও যালিম হবে, তারা এ পুরস্কার পাবে না। ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম-এর এই পরীক্ষার উদ্দেশ্য ছিল পরীক্ষার মাধ্যমে স্বীয় বন্ধুর লালন করে তাকে পূর্ণত্বের স্তর পর্যন্ত পৌছানো সন্তানদের জন্য এ দো’আর মধ্যে আরও একটি তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দেয় যে, সমাজে যারা গণ্য-মান্য, তাদের সন্তানরা পিতার পথ অনুসরণ করলে সমাজে তাদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। খলীলুল্লাহ ‘আলাইহিস সালাম-এর এ দোআটিও কবুল হয়েছে। তার বংশধরদের মধ্যে কখনো সত্যদ্বীনের অনুসারী ও আল্লাহ্‌র আজ্ঞাবহ আদর্শ পুরুষের অভাব হয়নি। জাহেলিয়াত আমলে আরবে যখন সর্বত্র মূর্তিপূজার জয়-জয়কার, তখনো ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম-এর বংশধরের মধ্যে কিছু লোক একত্ববাদ ও আখেরাতে বিশ্বাসী এবং আল্লাহ্‌র আনুগত্যশীল ছিলেন। যেমন, যায়েদ ইবনে আমর, ওরাকা ইবন নওফাল এবং কেস ইবন সায়েদা প্রমূখ।

Tafsir Bayaan Foundation

আর স্মরণ কর, যখন ইবরাহীমকে তার রব কয়েকটি বাণী দিয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর সে তা পূর্ণ করল। তিনি বললেন, ‘আমি তোমাকে মানুষের জন্য নেতা বানাব’। সে বলল, ‘আমার বংশধরদের থেকেও’? তিনি বললেন, ‘যালিমরা আমার ওয়াদাপ্রাপ্ত হয় না’।

Muhiuddin Khan

যখন ইব্রাহীমকে তাঁর পালনকর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর তিনি তা পূর্ণ করে দিলেন, তখন পালনকর্তা বললেন, আমি তোমাকে মানবজাতির নেতা করব। তিনি বললেন, আমার বংশধর থেকেও! তিনি বললেন আমার অঙ্গীকার অত্যাচারীদের পর্যন্ত পৌঁছাবে না।

Zohurul Hoque

আর স্মরণ করো! ইব্রাহীমকে তাঁর প্রভু কয়েকটি নির্দেশ দ্বারা পরীক্ষা করলেন, আর তিনি সেগুলো সম্পাদন করলেন। তিনি বললেন -- “আমি নিশ্চয়ই তোমাকে মানবজাতির জন্য ইমাম করতে যাচ্ছি।” তিনি বললেন -- “আর আমার বংশধরগণ থেকে?” তিনি বললেন -- “আমার অঙ্গীকার অন্যায়কারীদের উপরে বর্তায় না।”