কুরআন মজীদ সূরা আল আ'রাফ আয়াত ৮০
Qur'an Surah Al-A'raf Verse 80
আল আ'রাফ [৭]: ৮০ ~ শব্দ অনুবাদ দ্বারা শব্দ
وَلُوْطًا اِذْ قَالَ لِقَوْمِهٖٓ اَتَأْتُوْنَ الْفَاحِشَةَ مَا سَبَقَكُمْ بِهَا مِنْ اَحَدٍ مِّنَ الْعٰلَمِيْنَ (الأعراف : ٧)
- walūṭan
- وَلُوطًا
- And Lut
- এবং লুতকে (পাঠিয়েছিলাম)
- idh
- إِذْ
- when
- (স্মরণ করো) যখন
- qāla
- قَالَ
- he said
- সে বলেছিলো
- liqawmihi
- لِقَوْمِهِۦٓ
- to his people
- উদ্দেশ্যে জাতির তার
- atatūna
- أَتَأْتُونَ
- "Do you commit
- "কি তোমরা আসো
- l-fāḥishata
- ٱلْفَٰحِشَةَ
- (such) immorality
- (এমন) অশ্লীলকাজে
- mā
- مَا
- not
- (যা) না
- sabaqakum
- سَبَقَكُم
- has preceded you
- পূর্বে করেছে তোমাদের
- bihā
- بِهَا
- therein
- ব্যাপারে সে
- min
- مِنْ
- any
- কোনো
- aḥadin
- أَحَدٍ
- one
- একজন
- mina
- مِّنَ
- of
- মধ্যে
- l-ʿālamīna
- ٱلْعَٰلَمِينَ
- the worlds?
- সারা বিশ্বের
Transliteration:
Wa Lootan iz qaala liqawmiheee ataatoonal faahishata maa sabaqakum bihaa min ahadim minal 'aalameen(QS. al-ʾAʿrāf:80)
English Sahih International:
And [We had sent] Lot when he said to his people, "Do you commit such immorality as no one has preceded you with from among the worlds [i.e., peoples]? (QS. Al-A'raf, Ayah ৮০)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
আর আমি লূতকে পাঠিয়েছিলাম। যখন সে তার জাতিকে বলেছিল, ‘তোমরা এমন নির্লজ্জতার কাজ করছ যা বিশ্বজগতে তোমাদের পূর্বে কোন একজনও করেনি।’ (আল আ'রাফ, আয়াত ৮০)
Tafsir Ahsanul Bayaan
আমি লূত্বকেও পাঠিয়েছিলাম,[১] সে তার সম্প্রদায়কে বলেছিল, ‘তোমরা এমন কুকর্ম করছ যা তোমাদের পূর্বে বিশ্বে কেউ করেনি।
[১] লূত্ব (আঃ) ছিলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর ভাইপো এবং তিনি সেই লোকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, যারা ইবরাহীম (আঃ)-এর উপর ঈমান এনেছিল। অতঃপর তাঁকেও আল্লাহ একটি অঞ্চলের নবী বানিয়ে প্রেরণ করলেন। আর এই অঞ্চলটি জর্ডান ও (প্যালেষ্টাইনের) বায়তুল মুক্বাদ্দাসের মধ্যস্থলে অবস্থিত ছিল; যাকে 'সাদূম' বলা হয়। এ ভূখন্ড ছিল বড়ই শস্য-শ্যামল। এখানে সর্বপ্রকার শস্যাদি এবং ফল-মূলের প্রাচুর্য ছিল। কুরআন এই স্থানকে مُؤْتَفِكَةٌ অথবা مُؤْتَفِكَاتٌশব্দে উল্লেখ করেছে। লূত্ব (আঃ) সর্বপ্রথম অথবা তাওহীদের দাওয়াত দেওয়ার সাথে সাথে (যা ছিল প্রত্যেক নবীর মৌলিক দাওয়াত এবং সর্বপ্রথম তাঁরা এরই প্রতি স্ব স্ব জাতিকে দাওয়াত দিতেন। যেমন, পূর্বে নবীদের আলোচনায় এ কথা উল্লিখিত হয়েছে।) পুরুষ-সঙ্গমের যে মহা অপরাধ তাঁর জাতির মাঝে বিদ্যমান ছিল, তার জঘন্য ও ঘৃণ্য হওয়ার কথাও তাদের কাছে বর্ণনা করেন। এটা একটি এমন অপরাধ, যে অপরাধ পৃথিবীতে সর্বপ্রথম লূত্ব (আঃ)-এর জাতিই আরম্ভ করেছিল। আর এরই কারণে এ কুকর্মের নাম হয়ে পড়েছে 'লিওয়াত্বাত'। তাই এটাই সমীচীন ছিল, এই জাতিকে প্রথমে এই অপরাধের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবগত করানো। তাছাড়া ইবরাহীম (আঃ)-এর মাধ্যমে তাওহীদের দাওয়াত এখানে পৌঁছে থাকবে। সমলিঙ্গী ব্যভিচারের শাস্তির ব্যাপারে ইমামদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। কোন কোন ইমামের নিকট এর শাস্তিও তা-ই, যা ব্যভিচারের শাস্তি। অর্থাৎ, অপরাধী যদি বিবাহিত হয়, তবে 'রজম' তথা পাথর মেরে হত্যা করা এবং অবিবাহিত হলে একশ' বেত্রাঘাত। আবার কেউ কেউ বলেছেন, এর শাস্তিই হল 'রজম' করা, তাতে অপরাধী বিবাহিত হোক বা অবিবাহিত। কারো কারো মত হল, কর্তা ও কৃতরমন উভয়কেই হত্যা করে দেওয়া উচিত। অবশ্য ইমাম আবূ হানীফা (রঃ) কেবল শিক্ষামূলক শাস্তি দেওয়ার পক্ষপাতী, দন্ডদানের নন। (তুহফাতুল আহওয়াযী ৫/১৭)
Tafsir Abu Bakr Zakaria
আর আমি লূতকেও [১] পাঠিয়েছিলাম [২]। তিনি তার সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, ‘তোমারা কি এমন খারাপ কাজ করে যাচ্ছ যা তোমাদের আগে সৃষ্টিকুলের কেউ কারেনি ?
[১] লূত ‘আলাইহিসসালাম ছিলেন ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালামের ভ্রাতুষ্পুত্র। উভয়ের মাতৃভূমি ছিল পশ্চিম ইরাকে বসরার নিকটবর্তী প্রসিদ্ধ বাবেল শহর। এখানে মূর্তিপূজার ব্যাপক প্রচলন ছিল। স্বয়ং ইবরাহীম আলাইহিস সালামের পরিবারও মূর্তিপূজায় লিপ্ত ছিল। তাদের হিদায়াতের জন্য আল্লাহ্ তা'আলাইবরাহীম আলাইহিস সালামকে নবী করে পাঠান। কিন্তু সবাই তার বিরুদ্ধাচরণ করে এবং ব্যাপারটি নমরূদের অগ্নি পর্যন্ত গড়ায়। স্বয়ং পিতা তাকে গৃহ থেকে বহিষ্কার করার হুমকি দেন। নিজ পরিবারের মধ্যে শুধু স্ত্রী সারা ও ভ্রাতুষ্পপুত্র লুত মুসলিম হন। অবশেষে তাদেরকে সাথে নিয়ে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম দেশ ছেড়ে সিরিয়ায় হিজরত করেন। জর্দান নদীর তীরে পৌছার পর আল্লাহর নির্দেশে ইবরাহীম আলাইহিস্ সালাম বায়তুল মোকান্দাসের অদূরেই বসতি স্থাপন করেন।
লুত আলাইহিস সালামকেও আল্লাহ্ তা'আলা নবুওয়াত দান করে জর্দান ও বায়তুল মোকান্দাসের মধ্যবর্তী সাদূমের অধিবাসীদের পথ প্রদর্শনের জন্য প্রেরণ করেন। এ এলাকায় বেশ কয়েকটি বড় বড় শহর ছিল। কুরআনুল কারীম বিভিন্ন স্থানে এদের সমষ্টিকে ‘মু'তাফেকা' ও 'মু'তাফেকাত’ শব্দে বর্ণনা করেছে। এসব শহরের মধ্যে সাদূমকেই রাজধানী মনে করা হত। লুত ‘আলাইহিস সালাম এখানেই অবস্থান করতেন। এ এলাকার ভূমি ছিল উর্বর ও শস্যশ্যামল। এখানে সর্বপ্রকার শস্য ও ফলের প্রাচুর্য ছিল। আল্লাহ্ তা'আলা লুত আলাইহিস সালামকে তাদের হেদায়াতের জন্য নিযুক্ত করেন। তিনি স্বজাতিকে সম্বোধন করে বলেনঃ “তোমরা এমন অশ্লীল কাজ কর, যা তোমাদের পূর্বে পৃথিবীর কেউ করেনি।” অর্থাৎ লুত আলাইহিস সালামের জাতি নারীদেরকে বাদ দিয়ে পুরুষদের সাথে কাম প্রবৃত্তি চরিতার্থ করত। এটা ছিল এমন কাজ যা এর পূর্বে কোন জাতি করেনি। এজন্য আল্লাহ্ তা'আলা বলছেনঃ তোমরা মনুষ্যত্বের সীমা অতিক্রমকারী সম্পপ্রদায়। প্রত্যেক কাজে সীমা অতিক্রম করাই তোমাদের আসল রোগ। যৌন কামনার ক্ষেত্রেও তোমরা আল্লাহর নির্ধারিত সীমা ডিঙ্গিয়ে স্বভাববিরুদ্ধ কাজে লিপ্ত হয়েছ। লুত আলাইহিস সালামের উপদেশের জবাবে তার সম্প্রদায় বললঃ এরা বড় পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন বলে দাবী করে। এদের চিকিৎসা এই যে, এদেরকে বস্তি থেকে বের করে দাও। তখন গোটা জাতিই আল্লাহর আযাবে পতিত হল। শুধু লুত আলাইহিস সালাম ও তার কয়েকজন সঙ্গী আযাব থেকে বেঁচে রইলেন। আল্লাহ বলেনঃ “আমি লুত ও তার পরিবারকে আযাব থেকে বাচিয়ে রেখেছি।” কারণ, লুত আলাইহিস সালামের ঘরের লোকেরাই শুধু মুসলিম ছিল। সুতরাং তারাই আযাব থেকে মুক্তি পেল। অবশ্য তাদের মধ্যে তার স্ত্রী অন্তর্ভুক্ত ছিল না। সারকথা এই যে, গোণা-গুণতি কয়েকজন মুসলিম ছিল। তাদেরকে আযাব থেকে বাঁচানোর জন্য আল্লাহ তা'আলা লুত ‘আলাইহিস সালামকে নির্দেশ দেন যে, স্ত্রী ব্যতীত অন্যান্য পরিবার-পরিজন ও সম্পর্কশীল লোককে নিয়ে শেষ রাত্রে বস্তি থেকে বের হয়ে যান এবং পিছনে ফিরে দেখবেন না। কেননা, আপনি যখন বস্তি থেকে বের হয়ে যাবেন, তখনই কালবিলম্ব না করে আযাব এসে যাবে। লুত 'আলাইহিস সালাম এ নির্দেশ মত স্বীয় পরিবার-পরিজন ও সম্পর্কশীলদেরকে নিয়ে শেষ রাত্রে সাদূম ত্যাগ করেন। তার স্ত্রী প্রসঙ্গে দুরকম বর্ণনা রয়েছে। এক বর্ণনা অনুযায়ী সে সঙ্গে রওয়ানাই হয়নি। দ্বিতীয় বর্ণনায় আছে, কিছু দূর সঙ্গে চলার পর আল্লাহর নির্দেশের বিপরীতে পিছনে ফিরে বস্তিবাসীদের অবস্থা দেখতে চেয়েছিল। ফলে সাথে সাথে আযাব এসে তাকেও পাকড়াও করল। কুরআনুল কারীমের বিভিন্ন জায়গায় এ ঘটনাটি সংক্ষেপে ও বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। তাদের উপর আপতিত আযাব সম্পর্কে আল্লাহ্ তা'আলা বলেনঃ যখন আমার আযাব এসে গেল, তখন আমি বস্তিটিকে উল্টে দিলাম এবং তাদের উপর স্তরে স্তরে প্রস্তর বর্ষণ করলাম যা আপনার প্রতিপালকের নিকট চিহ্নযুক্ত ছিল। সে বস্তিটি এ কাফেরদের থেকে বেশী দূরে নয়।
এতে বুঝা যাচ্ছে যে, উপর থেকে প্রস্তর বর্ষিত হয়েছে এবং নীচে থেকে জীবরাঈল আলাইহিস সালাম গোটা ভূখণ্ডকে উপরে তুলে উল্টে দিয়েছেন। সূরা আলহিজরের আয়াতে এ আযাবের বর্ণনার পূর্বে বলা হয়েছেঃ সূর্যোদয়ের সময় বিকট শব্দ তাদেরকে পাকড়াও করল। লুত ‘আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়ের উপর পতিত ভয়াবহ আযাবসমূহের মধ্যে ভূখণ্ড উল্টে দেয়ার আযাবটি তাদের অশ্লীল ও নির্লজ্জ কাজের সাথে বিশেষ সঙ্গতিও রাখে। কারণ, তারা সিদ্ধ পন্থার বিপরীত কাজ করেছিল। সূরাঃ হুদের বর্ণিত আয়াতসমূহের শেষে আল্লাহ্ তাআলা আরবদেরকে হুশিয়ার করে এ কথাও বলেছে যে, উল্টে দেয়া বস্তিগুলো যালেমদের কাছ থেকে বেশী দূরে নয়। সিরিয়া গমনের পথে সব সময়ই সেগুলো তাদের চোখের সামনে পড়ে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তারা তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না। এ দৃশ্য শুধু কুরআন নাযিলের সময়েরই নয়, আজও বিদ্যমান রয়েছে। বায়তুল মুকাদাস ও জর্দান নদীর মাঝখানে আজও এ ভূখণ্ডটি ‘লুত সাগর' অথবা ‘মৃত সাগর’ নামে পরিচিতি। এর ভূ-ভাগ সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে অনেক নীচে অবস্থিত। এর একটি বিশেষ অংশে নদীর আকারে আশ্চর্য ধরণের পানি বিদ্যমান। এ পানিতে কোন মাছ, ব্যাঙ ইত্যাদি জীবিত থাকতে পারে না। এ কারণেই একে মৃত সাগর বলা হয়। কথিত আছে, এটাই সাদূমের অবস্থান স্থল। [ড.শাওকী আবু খালীল, আতলাসুল কুরআন, পৃ. ৫৭-৬১]
[২] বর্তমানে যে এলাকাটিকে ট্রান্স জর্দান বলা হয় সেখানেই ছিল এ জাতিটির বাস। ইরাক ও ফিলিস্তিনের মধ্যবর্তী স্থানে এ এলাকাটি অবস্থিত। এ এলাকা এমনই শ্যামল সবুজে পরিপূর্ণ ছিল যে, মাইলের পর মাইল জুড়ে এ বিস্তৃত এলাকা যেন একটি বাগান মনে হতো। এ এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মানুষকে মুগ্ধ ও বিমোহিত করত। কিন্তু আজ এ জাতির নাম-নিশানা দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এমনকি তাদের জনপদগুলো কোথায় কোথায় অবস্থিত ছিল তাও আজ সঠিকভাবে জানা যায় না। মৃত সাগরই তাদের একমাত্র স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে টিকে আছে।
Tafsir Bayaan Foundation
আর (প্রেরণ করেছি) লূতকে। যখন সে তার কওমকে বলল, ‘তোমরা কি এমন অশ্লীল কাজ করছ, যা তোমাদের পূর্বে সৃষ্টিকুলের কেউ করেনি’?
Muhiuddin Khan
এবং আমি লূতকে প্রেরণ করেছি। যখন সে স্বীয় সম্প্রদায়কে বললঃ তোমরা কি এমন অশ্লীল কাজ করছ, যা তোমাদের পূর্বে সারা বিশ্বের কেউ করেনি ?
Zohurul Hoque
আর লূত। স্মরণ করো! তিনি তাঁর লোকদের বললেন -- ''তোমরা কি এমন অশ্লীলতা করছো যা তোমাদের পূর্বে জগদ্বাসীদের আর কেউ চালু করে নি?