কুরআন মজীদ সূরা আল আনআম আয়াত ১৫১
Qur'an Surah Al-An'am Verse 151
আল আনআম [৬]: ১৫১ ~ শব্দ অনুবাদ দ্বারা শব্দ
۞ قُلْ تَعَالَوْا اَتْلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمْ عَلَيْكُمْ اَلَّا تُشْرِكُوْا بِهٖ شَيْـًٔا وَّبِالْوَالِدَيْنِ اِحْسَانًاۚ وَلَا تَقْتُلُوْٓا اَوْلَادَكُمْ مِّنْ اِمْلَاقٍۗ نَحْنُ نَرْزُقُكُمْ وَاِيَّاهُمْ ۚوَلَا تَقْرَبُوا الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَۚ وَلَا تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِيْ حَرَّمَ اللّٰهُ اِلَّا بِالْحَقِّۗ ذٰلِكُمْ وَصّٰىكُمْ بِهٖ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُوْنَ (الأنعام : ٦)
- qul
- قُلْ
- Say
- বলো
- taʿālaw
- تَعَالَوْا۟
- "Come
- "তোমরা আসো
- atlu
- أَتْلُ
- I will recite
- তিলাওয়াত করবো আমি
- mā
- مَا
- what
- যা
- ḥarrama
- حَرَّمَ
- has prohibited
- নিষেধ করেছেন
- rabbukum
- رَبُّكُمْ
- your Lord
- রব তোমাদের
- ʿalaykum
- عَلَيْكُمْۖ
- to you
- উপর তোমাদের
- allā
- أَلَّا
- That (do) not
- (তা এই) যে না
- tush'rikū
- تُشْرِكُوا۟
- associate
- তোমরা শিরক করো
- bihi
- بِهِۦ
- with Him
- সাথে তাঁর
- shayan
- شَيْـًٔاۖ
- anything
- কোনো কিছুকে
- wabil-wālidayni
- وَبِٱلْوَٰلِدَيْنِ
- and with the parents
- এবং সাথে পিতামাতার
- iḥ'sānan
- إِحْسَٰنًاۖ
- (be) good
- সদ্ব্যবহার করবে
- walā
- وَلَا
- and (do) not
- এবং না
- taqtulū
- تَقْتُلُوٓا۟
- kill
- তোমরা হত্যা করো
- awlādakum
- أَوْلَٰدَكُم
- your children
- সন্তানদের তোমাদের
- min
- مِّنْ
- (out) of
- ভয়ে
- im'lāqin
- إِمْلَٰقٍۖ
- poverty
- দারিদ্রের
- naḥnu
- نَّحْنُ
- We
- আমরা
- narzuqukum
- نَرْزُقُكُمْ
- provide for you
- আমরা জীবিকা দিই তোমাদের
- wa-iyyāhum
- وَإِيَّاهُمْۖ
- and for them
- এবং তাদেরকেও
- walā
- وَلَا
- And (do) not
- এবং না
- taqrabū
- تَقْرَبُوا۟
- go near
- তোমরা নিকটে যেও
- l-fawāḥisha
- ٱلْفَوَٰحِشَ
- [the] immoralities
- অশ্লীলতার
- mā
- مَا
- what
- যা
- ẓahara
- ظَهَرَ
- (is) apparent
- প্রকাশ্য (হোক)
- min'hā
- مِنْهَا
- of them
- তা হতে
- wamā
- وَمَا
- and what
- কিংবা যা
- baṭana
- بَطَنَۖ
- (is) concealed
- অপ্রকাশ্য (তাও)
- walā
- وَلَا
- And (do) not
- এবং না
- taqtulū
- تَقْتُلُوا۟
- kill
- তোমরা হত্যা করো
- l-nafsa
- ٱلنَّفْسَ
- the soul
- কোনো প্রাণকে
- allatī
- ٱلَّتِى
- which
- যাকে
- ḥarrama
- حَرَّمَ
- has (been) forbidden
- নিষিদ্ধ করেছেন
- l-lahu
- ٱللَّهُ
- (by) Allah
- আল্লাহ্
- illā
- إِلَّا
- except
- ছাড়া
- bil-ḥaqi
- بِٱلْحَقِّۚ
- by (legal) right
- কারণ যথার্থ (যেমন জিহাদে)
- dhālikum
- ذَٰلِكُمْ
- That
- এটা
- waṣṣākum
- وَصَّىٰكُم
- (He) has enjoined on you
- নির্দেশ দিচ্ছেন তোমাদের
- bihi
- بِهِۦ
- with it
- সম্পর্কে তা
- laʿallakum
- لَعَلَّكُمْ
- so that you may
- যাতে তোমরা
- taʿqilūna
- تَعْقِلُونَ
- use reason"
- অনুধাবন করো"
Transliteration:
Qul ta'aalaw atlu maa harrama Rabbukum 'alaikum allaa tushrikoo bihee shai'anw wa bilwaalidaini ihsaananw wa laa taqtulooo aw alaadakum min imlaaq; nahnu narzuqukum wa iyyaahum wa laa taqrabul fawaahisha maa zahara minhaa wa maa batana wa laa taqtulun nafsal latee harramal laahu illaa bilhaqq; zaalikum wassaakum bihee la'allakum ta'qiloon(QS. al-ʾAnʿām:151)
English Sahih International:
Say, "Come, I will recite what your Lord has prohibited to you. [He commands] that you not associate anything with Him, and to parents, good treatment, and do not kill your children out of poverty; We will provide for you and them. And do not approach immoralities – what is apparent of them and what is concealed. And do not kill the soul which Allah has forbidden [to be killed] except by [legal] right. This has He instructed you that you may use reason." (QS. Al-An'am, Ayah ১৫১)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
বল, ‘এসো, তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্য যা নিষিদ্ধ করেছেন তা পড়ে শোনাই, তা এই যে, তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করো না, পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার কর, দরিদ্রতার ভয়ে তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না, আমিই তোমাদেরকে আর তাদেরকে জীবিকা দিয়ে থাকি, প্রকাশ্য বা গোপন কোন অশ্লীলতার কাছেও যেয়ো না, আল্লাহ যে প্রাণ হরণ করা হারাম করেছেন তা ন্যায় সঙ্গত কারণ ছাড়া হত্যা করো না। এ সম্পর্কে তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যাতে তোমরা চিন্তা- ভাবনা করে কাজ কর। (আল আনআম, আয়াত ১৫১)
Tafsir Ahsanul Bayaan
বল, এসো, তোমাদের জন্য তোমাদের প্রতিপালক যা নিষিদ্ধ করেছেন তা তোমাদেরকে পড়ে শোনাই।[১] তা এইঃ তোমরা কোন কিছুকে তাঁর অংশী করবে না,[২] মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করবে,[৩] দারিদ্রে্র কারণে তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না।[৪] আমিই তোমাদেরকে ও তাদেরকে জীবিকা দিয়ে থাকি। প্রকাশ্যে হোক কিংবা গোপনে হোক, অশ্লীল আচরণের নিকটবর্তীও হয়ো না এবং আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ব্যতীত[৫] তাকে হত্যা করো না। তোমাদেরকে তিনি এ নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা অনুধাবন কর।
[১] অর্থাৎ, সেগুলো নয়, যেগুলো তোমরা আল্লাহর অবতীর্ণকৃত কোন দলীল ছাড়া কেবল নিজেদের ভ্রান্ত খেয়াল এবং অমূলক ধারণার ভিত্তিতে হারাম গণ্য করেছ। বরং হারাম হল সেই জিনিসগুলো, যেগুলোকে তোমাদের প্রতিপালক হারাম ঘোষণা করেছেন। কারণ, তোমাদের স্রষ্টা এবং আহারদাতা তিনিই এবং প্রতিটি জিনিসের জ্ঞানও তাঁরই কাছে। কাজেই এ অধিকারও তাঁরই যে, তিনি যে জিনিসটা চান হালাল এবং যে জিনিসটা চান হারাম করেন। সুতরাং আমি তোমাদেরকে এই জিনিসগুলোর বিশদ বিবরণ দিচ্ছি, যার তাকীদ তোমাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে এসেছে।
[২] أَلاَّ تُشْرِكُوْا এর পূর্বে أَوْصَاكُمْ ঊহ্য আছে। অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাঁর সাথে তোমরা অন্য কাউকে অংশীদার স্থাপন করো না। শিরক হল সব চেয়ে বড় পাপ। (তওবা ছাড়া) এ পাপের কোন ক্ষমা নেই। মুশরিকের উপর জান্নাত হারাম এবং জাহান্নাম ওয়াজিব। কুরআন মাজীদে এ বিষয়টিকে বিভিন্নভাবে বারবার বর্ণনা করা হয়েছে এবং নবী করীম (সাঃ)ও বহু হাদীসে এর বিশ্লেষণ সুস্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করেছেন। তা সত্ত্বেও বাস্তব এটাই যে, মানুষ শয়তানের চক্রান্তে পড়ে ব্যাপকহারে শিরকী কাজ সম্পাদন করে চলেছে।
[৩] অর্থাৎ, মাতা-পিতার সাথে অসদ্ব্যবহার করবে না। মহান আল্লাহর তাওহীদ (একত্বতা) এবং তাঁর আনুগত্যের পর এখানেও (এবং কুরআনের অন্য অনেক স্থানেও) পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর এ থেকে এ কথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, প্রতিপালকের আনুগত্যের পর পিতা-মাতার আনুগত্য করার গুরুত্ব অপরিসীম। যদি কেউ এই 'রুবূবিয়্যাতে সুগরা' (পিতা-মাতার আনুগত্য ও তাদের সাথে সদ্ব্যবহারের) দাবীসমূহ পূরণ না করে, তবে সে 'রুবূবিয়্যাতে কুবরা' (আল্লাহর আনুগত্যের) দাবীসমূহ পূরণ করতেও অসফল হবে।
[৪] জাহেলী যুগের এই জঘন্য কাজ বর্তমানে জন্ম-নিয়ন্ত্রণের নামে সারা পৃথিবীতে অতি ধুমধামের সাথে চলছে। আল্লাহ এ থেকে আমাদেরকে হিফাযত করুন!
[৫] অর্থাৎ, খুনের বদলে খুন। আর তা কেবল বৈধই নয়, বরং নিহতের উত্তরাধিকারী যদি মাফ করে না দেয়, তবে এ হত্যা অতি জরুরী। মহান আল্লাহ বলেন, {وَلَكُمْ فِي الْقِصَاصِ حَيَاةٌ} "ক্বিসাসে রয়েছে তোমাদের জন্য জীবন।" (সূরা বাক্বারাহ ২;১৭৯)
Tafsir Abu Bakr Zakaria
বলুন [১], ‘এস [২], তোমাদের রব তোমাদের উপর যা হারাম করেছেন তোমাদেরকে তা তিলাওয়াত করি, তা হচ্ছে , ‘ তোমারা তাঁর সাথে কোন শরীক করবে না [৩], পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করবে [৪], দারিদ্রের ভয়ে তোমার তোমাদের সন্তানদের হত্যা করবে না, আমরাই তোমাদেরকে ও তাদেরকে রিযক দিয়ে থাকি [৫]।প্রকাশ্যে হোক কিংবা গোপনে হোক, অশ্লীল কাজের ধারে-কাছেও যাবে না [৬]। আল্লাহ্ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ছাড়া তোমরা তাকে হত্যা করবে না [৭]।’ তোমাদেরকে তিনি এ নির্দেশ দিলেন যেন তোমরা বুঝতে পার।
ঊনিশতম রুকূ’
[১] আগত আয়াতসমূহে সেসব বস্তু সম্পর্কে বলা হয়েছে, যেগুলোকে আল্লাহ্ তা’আলা হারাম করেছেন। বিশদ বর্ণনায় নয়টি বস্তুর উল্লেখ হয়েছে। এরপর দশম নির্দেশ বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, “এ দ্বীনই হচ্ছে আমার সরল পথ। এ পথের অনুসরণ কর"। এতে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দ্বীন যে বিষয়কে হালাল বলেছে, তাকে হালাল এবং যে বিষয়কে হারাম বলেছে, তাকে হারাম মনে করবে- নিজের পক্ষ থেকে হালাল-হারামের ফতোয়া জারি করবে না। এতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আনীত পথকে অনুসরনের তাগিদ দেয়া হয়েছে। তাঁর পথ ব্যতীত আরও বহু পথ রয়েছে সেগুলো মানুষকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে। সঠিক পথ একটি, আর বাতিল পথ অনেক। যারা আল্লাহর পথে চলবে আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করবেন। [সা’দী]
আগত আয়াতসমূহে যে দশটি বিষয় বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে, (১) আল্লাহ্ তা'আলার সাথে কাউকে ইবাদাত ও আনুগত্যে অংশীদার স্থির করা, (২) পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার না করা, (৩) দারিদ্র্যের ভয়ে সন্তান হত্যা করা, (৪) অশ্লীল কাজ করা, (৫) কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা, (৬) ইয়াতীমের ধন-সম্পদ অবৈধভাবে আত্মসাৎ করা, (৭) ওজন ও মাপে কম দেয়া, (৮) সাক্ষ্য, ফয়সালা অথবা অন্যান্য কথাবার্তায় অবিচার করা, (৯) আল্লাহর অঙ্গীকার পূর্ণ না করা এবং (১০) আল্লাহ তা'আলার সোজা-সরল পথ ছেড়ে অন্য পথ অবলম্বন করা। মুফাসসির আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ সূরা আলে ইমরানের মুহকাম আয়াতের বর্ণনায় এ আয়াতগুলোকেই বোঝানো হয়েছে। আদম 'আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত সমস্ত নবীগণের শরী’আতই এসব আয়াত সম্পর্কে একমত। কোন দ্বীন বা শরী’আতে এগুলোর কোনটিই মনসূখ বা রহিত হয়নি। [মুস্তাদরাকে হাকিম; ২/৩১৭] আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘যে কেউ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশেষ যে বিষয়ের উপর ছিলেন সেটা জানতে চায় সে যেন সূরা আল-আন’আমের এ আয়াতগুলো পড়ে নেয়। [ইবন কাসীর]
[২] আয়াতগুলোর প্রথমেই বলা হয়েছে (تعَالوا) যার অর্থঃ ‘এস’। মূলতঃ উচ্চস্থানে দণ্ডায়মান হয়ে নিম্নের লোকদেরকে নিজের কাছে ডাকা অর্থে এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। [কাশশাফ; কুরতুবী] এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, এ দাওয়াত কবুল করার মধ্যেই তাদের জন্য শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্য বিদ্যমান। এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে সম্বোধন করে বলা হয়েছে যে, আপনি তাদেরকে বলুন, এস, যাতে আমি তোমাদেরকে ঐসব বিষয় পাঠ করে শোনাতে পারি যেগুলো আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের জন্য হারাম করেছেন। এটা প্রত্যক্ষভাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত
বার্তা। এতে কারো কল্পনা, আন্দাজ ও অনুমানের কোন প্রভাব নেই [বাগভী] যাতে তোমরা এসব বিষয় থেকে আত্মরক্ষা করতে যত্নবান হও এবং অনর্থক নিজের পক্ষ থেকে আল্লাহর হালালকৃত বিষয়সমূহকে হারাম না কর। এ আয়াতে যদিও সরাসরি মক্কার মুশরিকদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে, কিন্তু বিষয়টি ব্যাপক হওয়ার কারণে সমগ্র মানব জাতিই এর আওতাধীন- মুমিন হোক কিংবা কাফের, আরব হোক কিংবা অনারব, উপস্থিত লোকজন হোক কিংবা অনাগত বংশধর। [দেখুন, তাফসীর আল-মানার]
[৩] সর্বপ্রথম মহাপাপ শির্ক, যা হারাম করা হয়েছেঃ
সযত্ন সম্বোধনের পর হারাম ও নিষিদ্ধ বিষয়সমূহের তালিকায় সর্বপ্রথম বলা হয়েছেঃ আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক বা অংশীদার করো না। আরবের মুশরিকদের মত দেব-দেবীদেরকে বা মূর্তিকে ইলাহ বা উপাস্য মনে করো না। ইয়াহুদী ও নাসারাদের মত নবীগণকে আল্লাহ কিংবা আল্লাহর পুত্র সাব্যস্ত করো না। অন্যদের মত ফিরিশতাদেরকে আল্লাহর কন্যা বলে আখ্যা দিও না। মূৰ্খ জনগণের মত নবী ও ওলীগণকে জ্ঞান ও শক্তি-সামর্থ্যে আল্লাহর সমতুল্য সাব্যস্ত করো না। আল্লাহর জন্য যে সমস্ত ইবাদাত করা হয়, তা অপর কাউকে দিও না; যেমন, দো’আ, যবেহ, মানত ইত্যাদি।
এখানে (شيئًا) এর অর্থ এরূপ হতে পারে যে, ‘জলী’ অর্থাৎ প্রকাশ্য শির্ক ও ‘খফী’ অর্থাৎ প্রচ্ছন্ন শিক- এ প্রকারদ্বয়ের মধ্য থেকে কোনটিতেই লিপ্ত হয়ো না। প্রকাশ্য শির্কের অর্থ সবাই জানে যে, ইবাদাত-আনুগত্য অথবা অন্য বিশেষ গুণে অন্যকে আল্লাহ তা'আলার সমতুল্য অথবা তাঁর অংশীদার সাব্যস্ত করা। প্রচ্ছন্ন শির্ক এই যে, নিজ কাজ-কর্মে দ্বীনী ও পার্থিব উদ্দেশ্যসমূহে এবং লাভ-লোকসানে আল্লাহ তা'আলাকে কার্যনির্বাহী বলে বিশ্বাস করেও কার্যতঃ অন্যান্যকে কার্যনির্বাহী মনে করা এবং যাবতীয় প্রচেষ্টা অন্যদের সাথেই জড়িত রাখা। এছাড়া লোক দেখানো ইবাদাত করা, অন্যদেরকে দেখানোর জন্য সালাত ইত্যাদি ঠিকমত আদায় করা, নাম-যশ লাভের উদ্দেশ্যে দান-সদকা করা অথবা কার্যতঃ লাভ-লোকসানের মালিক আল্লাহ ছাড়া অন্যকে সাব্যস্ত করা ইত্যাদিও প্রচ্ছন্ন শির্কের অন্তর্ভুক্ত। [দেখুন, আল-মানার; সা’দী; আশ-শিক ফীল কাদীম ওয়াল হাদীস, ১৬৮-১৮০; ১২৯৫-১৩১০]
[৪] দ্বিতীয় গোনাহ পিতা-মাতার সাথে অসদ্ব্যবহারঃ
আয়াতে বলা হয়েছেঃ “পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করা”। উদ্দেশ্য এই যে, পিতা-মাতার অবাধ্য হয়ো না। তাদেরকে কষ্ট দিও না; কিন্তু বিজ্ঞজনোচিত ভঙ্গিতে বলা হয়েছে যে, পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর। অন্য আয়াতে তাদের আনুগত্য ও সুখবিধানকে আল্লাহ তা'আলার ইবাদাতের সাথে সংযুক্ত করে বলা হয়েছে, “আপনার রব নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত করবে না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করবে”। [সূরা আল-ইসরা; ২৩] অন্য জায়গায় বলা হয়েছে, “আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর এবং পিতা-মাতার। তারপর আমার দিকেই প্রত্যাবর্তন”। [সূরা লুকমান;১৪] অর্থাৎ বিপরীত করলে শাস্তি পাবে। তাছাড়া আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘সর্বোত্তম কাজ কোনটি’? তিনি উত্তরে বললেনঃ ‘সঠিক ওয়াক্তে সালাত আদায় করা', তিনি আবার প্রশ্ন করলেনঃ ‘এরপর কোনটি’? উত্তর হলঃ ‘পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার'। আবার প্রশ্ন করলেনঃ ‘এরপর কোনটি? উত্তর হলঃ 'আল্লাহর পথে জিহাদ'। [বুখারীঃ ৫২৭, মুসলিমঃ ৮৫] আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনবার বললেন, ‘লাঞ্ছিত হয়েছে, লাঞ্ছিত হয়েছে, লাঞ্ছিত হয়েছে’। সাহাবায়ে কেরাম আরয করলেনঃ ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! কে লাঞ্ছিত হয়েছে’? তিনি বললেনঃ ‘যে ব্যক্তি পিতা-মাতাকে বার্ধক্য অবস্থায় পেয়েও জান্নাতে প্রবেশ করতে পারে নি’। [মুসলিমঃ ২৫৫১]
[৫] তৃতীয় হারাম- সন্তান হত্যাঃ
আয়াতে বর্ণিত তৃতীয় হারাম বিষয় হচ্ছে সন্তান হত্যা। এখানে পূর্বাপর সম্পর্ক এই যে, ইতোপূর্বে পিতা-মাতার হক বর্ণিত হয়েছে, যা সন্তানের কর্তব্য। এখন সন্তানের হক বর্ণিত হচ্ছে, যা পিতা-মাতার কর্তব্য। জাহেলিয়াত যুগে সন্তানকে জীবন্ত পুঁতে ফেলা কিংবা হত্যা করার ব্যাপারটি ছিল সন্তানের সাথে অসদ্ব্যবহারের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। আয়াতে তা নিষিদ্ধ করে বলা হয়েছেঃ “দারিদ্র্যের কারণে স্বীয় সন্তানদেরকে হত্যা করো না। আমরা তোমাদেরকে এবং তাদেরকে- উভয়কেই জীবিকা দান করব”। জাহেলিয়াত যুগে এ নিকৃষ্টতম নির্দয়-পাষণ্ড প্রথা প্রচলিত ছিল যে, কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করলে কাউকে জামাতা করার লজ্জা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উদ্দেশ্যে তাকে জীবন্ত পুঁতে ফেলা হতো। মাঝে মাঝে জীবিকা নির্বাহ কঠিন হবে মনে করে পাষণ্ডরা নিজ হাতে সন্তানদেরকে হত্যা করত। কুরআনুল কারীম এ কু-প্রথা রহিত করে দিয়েছে। [ইবন কাসীর]
(৬) চতুর্থ হারাম নির্লজ্জ কাজঃ
আয়াতে বর্ণিত চতুর্থ হারাম বিষয় হচ্ছে নির্লজ্জ কাজ। এ সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ “প্রকাশ্য হোক কিংবা গোপন, যে কোন রকম অশ্লীলতার কাছেও যেয়ো না”। (فواحش) শব্দের সাধারণ অর্থঃ অশ্লীলতা ও নির্লজ্জ কাজ। যাবতীয় বড় গোনাহ (فحش) ও (فحشاء) এর অর্থের অন্তর্ভুক্ত। মোটকথা, এ আয়াত নির্লজ্জতার প্রকৃত অর্থের দিক দিয়ে বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ সমস্ত গোনাহকে এবং সাধারণের মধ্যে প্রসিদ্ধ অর্থের দিক দিয়ে ব্যভিচারের প্রকাশ্য ও গোপন সকল পন্থাকে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। এ সম্পর্কে নির্দেশ এই যে, এগুলোর কাছেও যেও না। কাছে যাওয়ার অর্থ এরূপ মজলিশ ও স্থান থেকে বেঁচে থাকা যেখানে গেলে গোনাহে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং এরূপ কাজ থেকেও বেঁচে থাক, যা দ্বারা এসব গোনাহর পথ খুলে যায়। কারণ, যে লোক নিষিদ্ধ জায়গার আশেপাশে ঘোরাফেরা করে, সে তাতে প্রবেশ করার কাছাকাছি হয়ে যায়। [সা'দী] অন্য আয়াতেও বলা হয়েছে, “বলুন, নিশ্চয় আমার রব হারাম করেছেন প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীলতা। " [সূরা আল-আ’রাফ; ৩৩] অনুরূপভাবে অন্যত্র এসেছে, “আর তোমরা প্রকাশ্য এবং প্রচ্ছন্ন পাপ বর্জন কর” [সূরা আল-আন’আমঃ ১২০] এ সব আয়াত একই অর্থবোধক। এসব আয়াতেই অশ্লীলতা ও নির্লজ্জতা পরিত্যাগ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহর চেয়ে বেশী আত্মাভিমানী কেউই নেই, সেজন্য তিনি প্রকাশ্য কিংবা অপ্রকাশ্য যাবতীয় অশ্লীলতা হারাম ঘোষণা করেছেন।‘ [বুখারী ৪৬৩৪; মুসলিম; ২৭৬০]
[৭] পঞ্চম হারাম বিষয় অন্যায় হত্যাঃ
এ সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ “আল্লাহ্ তা'আলা যাকে হত্যা করা হারাম করেছেন, তাকে হত্যা করো না, তবে ন্যায়ভাবে”। এ ন্যায়ভাবে’র ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ‘তিনটি কারণ ছাড়া কোন মুসলিমের খুন হালাল নয়। (এক) বিবাহিত হওয়া সত্বেও ব্যভিচারে লিপ্ত হলে, (দুই) অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করলে তার কেসাস হিসাবে তাকে হত্যা করা যাবে এবং (তিন) সত্যদ্বীন ইসলাম ত্যাগ করে মুরতাদ হয়ে মুসলিমদের জামা'আত থেকে পৃথক হয়ে গেলে। [বুখারীঃ ৬৮৭৮, মুসলিমঃ ১৬৭৬]
বিনা কারণে মুসলিমকে হত্যা করা যেমন হারাম, তেমনিভাবে এমন কোন অমুসলিমকে হত্যা করাও হারাম, যে কোন ইসলামী দেশের প্রচলিত আইন মান্য করে বসবাস করে কিংবা যার সাথে মুসলিমের চুক্তি থাকে। আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোন যিম্মী অমুসলিমকে হত্যা করে, সে আল্লাহর অঙ্গীকার ভঙ্গ করে। যে আল্লাহর অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, সে জান্নাতের গন্ধও পাবে না। অথচ জান্নাতের সুগন্ধী সত্তর বছরের দূরত্ব হতে পাওয়া যায়। [ইবন মাজাহ ২৬৮৭]
Tafsir Bayaan Foundation
বল, ‘এসো, তোমাদের উপর তোমাদের রব যা হারাম করেছেন, তা তিলাওয়াত করি যে, তোমরা তার সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না এবং মা-বাবার প্রতি ইহসান করবে আর দারিদ্রের কারণে তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না। আমিই তোমাদেরকে রিয্ক দেই এবং তাদেরকেও। আর অশ্লীল কাজের নিকটবর্তী হবে না- তা থেকে যা প্রকাশ পায় এবং যা গোপন থাকে। আর বৈধ কারণ ছাড়া তোমরা সেই প্রাণকে হত্যা করো না, আল্লাহ যা হারাম করেছেন। এগুলো আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা বুঝতে পার।
Muhiuddin Khan
আপনি বলুনঃ এস, আমি তোমাদেরকে ঐসব বিষয় পাঠ করে শুনাই, যেগুলো তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্যে হারাম করেছেন। তাএই যে, আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে অংশীদার করো না, পিতা-মাতার সাথে সদয় ব্যবহার করো স্বীয় সন্তানদেরকে দারিদ্রে?480; কারণে হত্যা করো না, আমি তোমাদেরকে ও তাদেরকে আহার দেই, নির্লজ্জতার কাছেও যেয়ো না, প্রকাশ্য হোক কিংবা অপ্রকাশ্য, যাকে হত্যা করা আল্লাহ হারাম করেছেন, তাকে হত্যা করো না; কিন্তু ন্যায়ভাবে। তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা বুঝ।
Zohurul Hoque
বলো -- ''এসো আমি বাতলে দিই তোমাদের প্রভু তোমাদের জন্য কি নিষেধ করেছেন, -- তোমরা তাঁর সঙ্গে অন্য কিছু শরিক করো না, আর পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার, আর তোমাদের সন্তানদের তোমরা হত্যা করো না দারিদ্রের কারণে,’’ -- আমারাই জীবিকা দিই তোমাদের ও তাদেরও, -- ''আর অশ্লিলতার ধারে-কাছেও যেও না তার যা প্রকাশ পায় ও যা গোপন থাকে, আর তেমন কোনো লোককে হত্যা করো না যাকে আল্লাহ্ নিষেধ করেছেন, -- যথাযথ কারণ ব্যতীত। এইসব দিয়ে তিনি তোমাদের আদেশ জারি করেছেন, যেন তোমরা বুঝতে পারো।