কুরআন মজীদ সূরা আল মায়িদাহ আয়াত ৪১
Qur'an Surah Al-Ma'idah Verse 41
আল মায়িদাহ [৫]: ৪১ ~ শব্দ অনুবাদ দ্বারা শব্দ
۞ يٰٓاَيُّهَا الرَّسُوْلُ لَا يَحْزُنْكَ الَّذِيْنَ يُسَارِعُوْنَ فِى الْكُفْرِ مِنَ الَّذِيْنَ قَالُوْٓا اٰمَنَّا بِاَفْوَاهِهِمْ وَلَمْ تُؤْمِنْ قُلُوْبُهُمْ ۛ وَمِنَ الَّذِيْنَ هَادُوْا ۛ سَمّٰعُوْنَ لِلْكَذِبِ سَمّٰعُوْنَ لِقَوْمٍ اٰخَرِيْنَۙ لَمْ يَأْتُوْكَ ۗ يُحَرِّفُوْنَ الْكَلِمَ مِنْۢ بَعْدِ مَوَاضِعِهٖۚ يَقُوْلُوْنَ اِنْ اُوْتِيْتُمْ هٰذَا فَخُذُوْهُ وَاِنْ لَّمْ تُؤْتَوْهُ فَاحْذَرُوْا ۗوَمَنْ يُّرِدِ اللّٰهُ فِتْنَتَهٗ فَلَنْ تَمْلِكَ لَهٗ مِنَ اللّٰهِ شَيْـًٔا ۗ اُولٰۤىِٕكَ الَّذِيْنَ لَمْ يُرِدِ اللّٰهُ اَنْ يُّطَهِّرَ قُلُوْبَهُمْ ۗ لَهُمْ فِى الدُّنْيَا خِزْيٌ ۖوَّلَهُمْ فِى الْاٰخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيْمٌ (المائدة : ٥)
- yāayyuhā
- يَٰٓأَيُّهَا
- O!
- হে
- l-rasūlu
- ٱلرَّسُولُ
- Messenger!
- রাসূল
- lā
- لَا
- Let not
- (যেন) না
- yaḥzunka
- يَحْزُنكَ
- grieve you
- তোমাকে দুঃখ দেয়
- alladhīna
- ٱلَّذِينَ
- those who
- (তাদের কার্যক্রম) যারা
- yusāriʿūna
- يُسَٰرِعُونَ
- hasten
- দ্রুত ধাবিত হয়
- fī
- فِى
- in (to)
- মধ্যে
- l-kuf'ri
- ٱلْكُفْرِ
- [the] disbelief
- অবিশ্বাসের
- mina
- مِنَ
- of
- মধ্য হতে
- alladhīna
- ٱلَّذِينَ
- those who
- (তাদের) যারা
- qālū
- قَالُوٓا۟
- said
- বলে
- āmannā
- ءَامَنَّا
- "We believe"
- "ঈমান এনেছি আমরা"
- bi-afwāhihim
- بِأَفْوَٰهِهِمْ
- with their mouths
- দিয়ে মুখগুলো তাদের
- walam
- وَلَمْ
- and not
- কিন্তু নি
- tu'min
- تُؤْمِن
- believe
- ঈমান আনে
- qulūbuhum
- قُلُوبُهُمْۛ
- their hearts
- অন্তরগুলো তাদের
- wamina
- وَمِنَ
- and from
- এবং মধ্য হতে
- alladhīna
- ٱلَّذِينَ
- those who
- (তাদের) যারা
- hādū
- هَادُوا۟ۛ
- (are) Jews
- ইয়াহুদী হয়েছে
- sammāʿūna
- سَمَّٰعُونَ
- They (are) listeners
- শুনতে বেশি আগ্রহী
- lil'kadhibi
- لِلْكَذِبِ
- to falsehood
- প্রতি মিথ্যার
- sammāʿūna
- سَمَّٰعُونَ
- (and) listeners
- শুনতে বেশি আগ্রহী
- liqawmin
- لِقَوْمٍ
- for people
- প্রতি সম্প্রদায়ের
- ākharīna
- ءَاخَرِينَ
- other
- অন্যান্য (যারা)
- lam
- لَمْ
- (who have) not
- নি
- yatūka
- يَأْتُوكَۖ
- come to you
- তোমার কাছে আসে
- yuḥarrifūna
- يُحَرِّفُونَ
- They distort
- তারা বিকৃত করে
- l-kalima
- ٱلْكَلِمَ
- the words
- (আল্লাহর) কথা
- min
- مِنۢ
- from
- থেকেও
- baʿdi
- بَعْدِ
- after
- পর
- mawāḍiʿihi
- مَوَاضِعِهِۦۖ
- their context
- প্রসঙ্গস্থান তার (নির্ধারণের)
- yaqūlūna
- يَقُولُونَ
- saying
- তারা বলে
- in
- إِنْ
- "If
- "যদি
- ūtītum
- أُوتِيتُمْ
- you are given
- দেয়া হয় তোমাদের
- hādhā
- هَٰذَا
- this
- এই (আদেশ)
- fakhudhūhu
- فَخُذُوهُ
- [so] take it
- তবে গ্রহণ করো তা
- wa-in
- وَإِن
- but if
- এবং যদি
- lam
- لَّمْ
- not
- না
- tu'tawhu
- تُؤْتَوْهُ
- you are given it
- দেয়া হয় তা
- fa-iḥ'dharū
- فَٱحْذَرُوا۟ۚ
- then beware"
- তবে তোমরা বর্জন করো"
- waman
- وَمَن
- And (for) whom
- এবং যাকে
- yuridi
- يُرِدِ
- intends
- চান
- l-lahu
- ٱللَّهُ
- Allah
- আল্লাহ
- fit'natahu
- فِتْنَتَهُۥ
- his trial
- তার পরীক্ষায় (ফেলতে)
- falan
- فَلَن
- then never
- তবে কখনও না
- tamlika
- تَمْلِكَ
- will you have power
- সক্ষম হবে তুমি
- lahu
- لَهُۥ
- for him
- তাকে (বাঁচাতে)
- mina
- مِنَ
- against
- থেকে
- l-lahi
- ٱللَّهِ
- Allah
- আল্লাহ
- shayan
- شَيْـًٔاۚ
- anything
- কিছু মাত্রও
- ulāika
- أُو۟لَٰٓئِكَ
- Those
- ঐসব লোক
- alladhīna
- ٱلَّذِينَ
- (are) the ones
- (তারাই) যাদের
- lam
- لَمْ
- never
- না
- yuridi
- يُرِدِ
- will intend
- চেয়েছেন
- l-lahu
- ٱللَّهُ
- Allah
- আল্লাহ
- an
- أَن
- that
- যে
- yuṭahhira
- يُطَهِّرَ
- He purifies
- পবিত্র করবেন
- qulūbahum
- قُلُوبَهُمْۚ
- their hearts
- অন্তরগুলোকে তাদের
- lahum
- لَهُمْ
- For them
- জন্যে তাদের (রয়েছে)
- fī
- فِى
- in
- মধ্যে
- l-dun'yā
- ٱلدُّنْيَا
- the world
- পৃথিবীর
- khiz'yun
- خِزْىٌۖ
- (is) disgrace
- অপমান
- walahum
- وَلَهُمْ
- and for them
- ও জন্যে তাদের (রয়েছে)
- fī
- فِى
- in
- মধ্যে
- l-ākhirati
- ٱلْءَاخِرَةِ
- the Hereafter
- আখেরাতে
- ʿadhābun
- عَذَابٌ
- (is) a punishment
- শাস্তি
- ʿaẓīmun
- عَظِيمٌ
- great
- কঠোর
Transliteration:
Yaaa ayyuhar Rasoolu laa yahzukal lazeena yusaa ri'oona fil kufri minal lazeena qaaloo aamannaa bi afwaahihim wa lam tu'min quloobuhum; wa minal lazeena haadoo sammaa'oona lilkazibi sammaa'oona liqawmin aakhareena lam yaatooka yuharifoonal kalima mim ba'di mawaadi'ihee yaqooloona in ooteetum haazaa fakhuzoohu wa il lam tu'tawhu fahzaroo; wa many-yuridil laahu fitnatahoo falan tamlika lahoo minal laahi shai'aa; ulaaa 'ikal lazeena lam yuridil laahu any-yutahhira quloobahum; lahum fid dunyaa khizyunw wa lahum fil Aakhirati'azaabun 'azeem(QS. al-Māʾidah:41)
English Sahih International:
O Messenger, let them not grieve you who hasten into disbelief of those who say, "We believe" with their mouths, but their hearts believe not, and from among the Jews. [They are] avid listeners to falsehood, listening to another people who have not come to you. They distort words beyond their [proper] places [i.e., usages], saying, "If you are given this, take it; but if you are not given it, then beware." But he for whom Allah intends fitnah – never will you possess [power to do] for him a thing against Allah. Those are the ones for whom Allah does not intend to purify their hearts. For them in this world is disgrace, and for them in the Hereafter is a great punishment. (QS. Al-Ma'idah, Ayah ৪১)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
হে রসূল! কুফরীর ব্যাপারে তাদের প্রতিযোগিতা যেন তোমাকে দুঃখ না দেয়, যারা মুখে বলে ঈমান এনেছি কিন্তু তাদের অন্তর ঈমান আনেনি। আর যারা ইয়াহূদী, তারা মিথ্যা কথা শুনতে বিশেষ পারদর্শী, তারা তোমার কথাগুলো অন্য সম্প্রদায়ের স্বার্থে কান পেতে শোনে যারা তোমার নিকট (কখনো) আসেনি, এরা আল্লাহর কিতাবের শব্দগুলোকে প্রকৃত অর্থ হতে বিকৃত করে। তারা বলে, তোমরা এ রকম নির্দেশপ্রাপ্ত হলে মানবে, আর তা না হলে বর্জন করবে। বস্তুত আল্লাহই যাকে ফিতনায় ফেলতে চান, তার জন্য আল্লাহর কাছে তোমার কিছুই করার নেই। ওরা হল সেই লোক, যাদের অন্তরাত্মাকে আল্লাহ পবিত্র করতে চান না। তাদের জন্য দুনিয়াতে আছে লাঞ্ছনা, আর তাদের জন্য আখেরাতে আছে মহা শাস্তি। (আল মায়িদাহ, আয়াত ৪১)
Tafsir Ahsanul Bayaan
হে রসূল! যারা মুখে বলে, ‘বিশ্বাস করেছি’ কিন্তু অন্তরে বিশ্বাসী নয় ও যারা ইয়াহুদী হয়েছে, তাদের মধ্যে যারা অবিশ্বাসে তৎপর, তাদের আচরণ যেন তোমাকে দুঃখ না দেয়।[১] ওরা মিথ্যা শ্রবণে (ও অনুসরণে) অত্যন্ত আগ্রহশীল, যে সম্প্রদায় তোমার নিকট আসেনি, ওরা তাদের জন্য (তোমার কথায়) কান পেতে (গোয়েন্দাগিরি করে) থাকে। (তাওরাতের) বাক্যগুলিকে ওর স্বস্থান হতে পরিবর্তন করে। তারা বলে, ‘এ প্রকার (বিকৃত বিধান) দিলে গ্রহণ কর এবং এ (বিকৃত বিধান) না দিলে বর্জন কর।’[২] আর আল্লাহ যার পথচ্যুতি চান, তার জন্য আল্লাহর নিকট তোমার কিছুই করার নেই। ঐ সকল লোকের হৃদয়কে আল্লাহ বিশুদ্ধ করতে চান না। তাদের জন্য আছে ইহকালে লাঞ্ছনা ও পরকালে মহাশাস্তি।
[১] কাফের ও মুশরিকদের ঈমান গ্রহণ না করা এবং সঠিক পথ অবলম্বন না করার ফলে নবী (সাঃ) যে অস্থিরতা ও আক্ষেপের শিকার হয়েছিলেন, তার জন্য আল্লাহ নিজ নবীকে অধিক চিন্তা না করার নির্দেশ দিয়েছেন। যাতে এ ব্যাপারে তিনি সান্ত্বনা পান যে এই লোকদের ব্যাপারে তিনি আল্লাহর নিকট জিজ্ঞাসিত হবেন না।
[২] ৪১ থেকে ৪৪নং আয়াতগুলির অবতীর্ণ হওয়ার কারণ হিসাবে দু'টি ঘটনা উল্লেখ করা হয়; (ক) বিবাহিত ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণী ইয়াহুদীর ঘটনা। এমনিতে তারা তাদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাতের মধ্যে বহু পরিবর্তন সাধন করেছিল, তার উপর তার অনেক বিধান অনুযায়ী আমল করত না। তার মধ্যে (একটি বিধান) রজম বা পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করার দন্ডবিধান; যা তাদের গ্রন্থে বিবাহিত ব্যভিচারী নারী-পুরুষের জন্য বিদ্যমান ছিল এবং যা আজও বিদ্যমান আছে। সুতরাং যেহেতু তারা এই শাস্তি থেকে রক্ষা পেতে চাচ্ছিল, সেহেতু তারা আপোসে সিদ্ধান্ত নিয়ে বলল যে, 'চল, আমরা মুহাম্মাদের নিকট যাই। তিনি যদি আমাদের মনগড়া শাস্তি দানের মতই চাবুক মেরে লাঞ্ছিত করার শাস্তির নির্দেশ দেন, তাহলে আমরা তা মান্য করে নেব। অন্যথা তিনি যদি রজম বা পাথর মেরে হত্যা করার নির্দেশ দেন, তাহলে আমরা তা মান্য করব না।' আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ) বলেন; ইয়াহুদীগণ রসূল (সাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হল। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, 'তোমাদের তাওরাতে রজমের ব্যাপারে কি নির্দেশ রয়েছে?' তারা বলল, 'তাওরাতে ব্যভিচারের শাস্তি হিসাবে তাকে চাবুক মারা ও লাঞ্ছিত করার কথা উল্লেখ আছে।' (এ কথা শুনে) আব্দুল্লাহ বিন সালাম (রাঃ) বললেন, 'তোমরা মিথ্যা বলছ। তাওরাতে পাথর ছুঁড়ে হত্যার নির্দেশ রয়েছে। যাও, তাওরাত নিয়ে এসো দেখি!' তারা তাওরাত নিয়ে এসে পড়তে শুরু করল বটে; কিন্তু রজমের আয়াতের উপর হাত রেখে দিয়ে পূর্বাপর সমস্ত পড়ে শুনালো। আব্দুল্লাহ বিন সালাম (রাঃ) বললেন, 'হাত সরিয়ে নাও!' হাত সরালে দেখা গেল যে, সেখানে রজমের আয়াত বিদ্যমান রয়েছে। তখন তাদেরকেও স্বীকার করতেই হল যে, মুহাম্মাদ (সাঃ) সত্যই বলছেন, তাওরাতে রজমের আয়াত আছে।(অতঃপর রসূল (সাঃ)-এর নির্দেশক্রমে) ব্যভিচারীদ্বয়কে পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করে দেওয়া হল। (বুখারী ও মুসলিম এবং অন্যান্য হাদীসগ্রন্থ দ্রষ্টব্য)
(খ) একটি অন্য ঘটনাও বর্ণনা করা হয় যে, ইয়াহুদীদের একটি গোত্র অন্য গোত্র অপেক্ষা বেশী সম্ভ্রান্ত ও মর্যাদাসম্পন্ন মনে করত। আর এই কারণেই নিজেদের লোক খুন হলে অপর গোত্রের নিকট হতে একশ' অসাক রক্তপণ দাবী করত। পক্ষান্তরে অন্য গোত্রের কেউ খুন হলে পঞ্চাশ অসাক রক্তপণ নির্ধারিত করত। যখন নবী (সাঃ) মদীনায় আগমন করলেন, তখন ইয়াহুদীদের দ্বিতীয় দল যাদের রক্তপণ অর্ধেক ছিল তারা উৎসাহ পেল। (অর্থাৎ তারা ভাবল যে, এবার আমরা ন্যায় বিচার পাব।) এবং তারা একশ' অসাক রক্তপণ দিতে অস্বীকার করল। আর এ নিয়ে তাদের মধ্যে লড়াই শুরু হওয়ার উপক্রম ছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে কয়েকজন বুদ্ধিমান লোক রসূল (সাঃ)-এর নিকট বিচার প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে সন্তুষ্টি প্রকাশ করলে ঐ সময় এই আয়াতগুলি অবতীর্ণ হয়। যার মধ্যে একটি আয়াতে রক্তপণের বিধান সকলের জন্য সমান বলা হয়েছে। (মুসনাদে আহমাদ ১/২৪৬, আহমাদ শাকের হাদীসটির সূত্রকে সহীহ বলেছেন।) ইবনে কাসীর (রঃ) বলেন, সম্ভবতঃ উভয় ঘটনাই একই সময়ের এবং উক্ত সকল কারণের জন্যই আয়াতগুলি অবতীর্ণ হয়েছে। (তাফসীরে ইবনে কাসীর)
Tafsir Abu Bakr Zakaria
হে রাসূল! আপনাকে যেন তারা চিন্তিত না করে যারা কুফরীর দিকে দ্রুত এগিয়ে যায় –যারা মুখে বলে, ‘ঈমান এনেছি’ অথচ তাদের অন্তর ঈমান আনেনি [১] –এবং যারা ইয়াহুদী[২] তারা (সকলেই) মিথ্যা শুনতে অধিক তৎপর [৩], আপনার কাছে আসে নি এমন এক ভিন্ন দলের পক্ষে যারা কান পেতে থাকে [৪]। শব্দগুলো যথাযথ সুবিন্যষ্ত থাকার পরও তারা সেগুলোর অর্থ বিকৃত করে [৫]। তারা বলে, ‘এরূপ বিধান দিলে গ্রহণ করো এবং সেরূপ না দিলে বর্জন করো’ [৬]। আর আল্লাহ যাকে ফিতনায় ফেলতে চান তার জন্য আল্লাহর কাছে আপনার কিছুই করার নেই। এরাই হচ্ছে তারা যাদের হৃদয়কে আল্লাহ বিশুদ্ধ করতে চান না; তাদের জন্য আছে দুনিয়ায় লাঞ্ছনা, আর তাদের জন্য রয়েছে আখেরাতে মহাশাস্তি।
[১] এরা হচ্ছে মুনাফিক। তারা মুখে ঈমানের কথা বললেও অন্তরে ঈমানের কোন অস্তিত্ব নেই। তারা মিথ্যা শুনতে অভ্যস্ত। [ইবন কাসীর]
[২] প্রাচীন কাল থেকেই ইয়াহুদীরা কখনো স্বজন-প্রীতির বশবর্তী হয়ে এবং কখনো নাম-যশ ও অর্থের লোভে ফতোয়াপ্রার্থীদের মনমত ফতোয়া তৈরী করে দিত। বিশেষতঃ অপরাধের শাস্তির ক্ষেত্রে এটিই ছিল তাদের সাধারণ প্রচলিত পদ্ধতি। কোন ধনী ব্যক্তি অপরাধ করলে তারা তাওরাতের গুরুতর শাস্তিকে লঘু শাস্তিতে পরিবর্তন করে দিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদীনায় হিজরত করলেন এবং ইসলামের অভূতপূর্ব সুন্দর ব্যবস্থা ইয়াহুদীদের সামনে এল, তখন তারা একে একটি সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে চাইল। যেসব ইয়াহুদী তাওরাতের রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিচারক নিযুক্ত করতে প্রয়াস পেত -যাতে একদিকে ইসলামের সহজ ও নরম বিধি-বিধান দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় এবং অন্য দিকে তাওরাত পরিবর্তন করার অপরাধ থেকেও অব্যাহতি পাওয়া যায়। কিন্তু এ ব্যাপারেও তারা একটি দুস্কৃতির আশ্রয় নিত। নিয়মিত বিচারক নিযুক্ত করার পূর্বে কোন না কোন পন্থায় মোকাদ্দমার রায় ফতোয়া হিসাবে জেনে নিতে চাইত। উদ্দেশ্য এ রায় তাদের আকাঙ্ক্ষিত রায়ের অনুরূপ হলে বিচারক নিযুক্ত করবে, অন্যথায় নয়। এসব কিছুই তাদের অন্তরের কলুষতা প্রমাণ করত। [দেখুন, তাফসীর সা’দী] বারা ইবন আযিব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের পাশ দিয়ে এক ইয়াহুদীকে মুখ কালো ও বেত্ৰাঘাত করা অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তিনি তাদেরকে ডেকে বললেন, তোমরা কি ব্যভিচারের শাস্তি এরকমই তোমাদের কিতাবে পাও? তারা বললঃ হ্যাঁ। তখন তিনি তাদের আলেমদের একজনকে ডেকে বললেন, “যে আল্লাহ মূসার উপর তাওরাত নাযিল এটাই ব্যভিচারের শাস্তি? সে বলল, না। তবে যদি আপনি আমাকে এর দোহাই দিয়ে জিজ্ঞেস না করতেন, তাহলে আমি কখনই তা বলতাম না। আমাদের কিতাবে আমরা এর শাস্তি হিসেবে ‘প্রস্তারাঘাতকেই দেখতে পাই। কিন্তু এটা আমাদের সমাজের উঁচু শ্রেণীর মধ্যে বৃদ্ধি পায়। ফলে আমাদের উঁচু শ্রেণীর কেউ সেটা করলে তাকে ছেড়ে দিতাম। আর নিম্নশ্রেণীর কেউ তা করলে তার উপর শরীআত নির্ধারিত হদ (তথা রজমের শাস্তি) প্রয়োগ করতাম। তারপর আমরা বললাম, আমরা এ ব্যাপারে এমন একটি বিষয়ে একমত হই যা আমাদের উঁচু-নীচু সকল শ্রেণীর উপর সমভাবে প্রয়োগ করতে পারি। তা থেকেই আমরা রজম বা প্রস্তারাঘাতের পরিবর্তে মুখ কালো ও চাবুক মারা নির্ধারণ করি। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘হে আল্লাহ! আমি প্রথম আপনার সেই মৃত নির্দেশকে বাস্তবায়ন করব, যখন তারা তা নিঃশেষ করে দিয়েছে। তখন তাকে রজম করার নির্দেশ দেয়া হল এবং তা বাস্তবায়িত হলো। তখন আল্লাহ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করলেন। [মুসলিম; ১৭০০]
[৩] অনুরূপভাবে ইয়াহুদীদেরও একটি বদভ্যাস হলো যে, তারা মিথ্যা ও ভ্রান্ত কথাবার্তা শোনাতে অভ্যস্ত। [ইবন কাসীরা] এসব ইয়াহুদী তাদের ধর্মীয় আলেমদের দ্বারা তাওরাতের নির্দেশাবলীর প্রকাশ্য বিরুদ্ধাচরণ দেখা সত্বেও তারা তাদেরই অনুসরণ এবং তাদের বর্ণিত মিথ্যা ও অমূলক কিসসা-কাহিনীই শুনতে থাকত। দ্বীনে তাদের মজবুতির অভাবে যে কোন মিথ্যা বলার জন্য বলা হলে, তারা তাতে অগ্রণী হয়ে যেত। [সা’দী]
[৪] এখানেও ইয়াহুদী ও মুনাফিকদের দ্বিতীয় একটি বদঅভ্যাস বর্ণনা করা হচ্ছে যে, এরা বাহ্যতঃ আপনার কাছে একটি দ্বনী বিষয় জিজ্ঞেস করতে এসেছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ধর্ম তাদের উদ্দেশ্য নয় এবং ধর্মীয় বিষয় জানার জন্যেও আসে নি। বরং তারা এমন একটি ইয়াহুদী সম্প্রদায়ের গুপ্তচর, যারা অহংকারবশতঃ আপনার কাছে আসেনি। তাদের বাসনা অনুযায়ী আপনার মত জেনে এরা তাদেরকে বলে দিতে চায়। এরপর মানা না মানা সম্পর্কে তারাই সিদ্ধান্ত নেবে। [ইবন কাসীর]
[৫] ইয়াহুদীদের তৃতীয় একটি বদ অভ্যাস হচ্ছে, তারা আল্লাহর কালামকে যথার্থ পরিবেশ থেকে সরিয়ে তার ভুল অর্থ করত এবং আল্লাহর নির্দেশকে বিকৃত করত। এ বিকৃতি ছিল দ্বিবিধঃ তাওরাতের ভাষায় কিছু হেরফের করা এবং ভাষা ঠিক রেখে তদস্থলে অযৌক্তিক ব্যাখ্যা ও পরিবর্তন করা। ইয়াহুদীরা উভয় প্রকার বিকৃতিতেই অভ্যস্ত ছিল। [ইবন কাসীর]
[৬] অর্থাৎ ইয়াহুদীরা তাদের লোকদেরকে নবীজীর কাছে পাঠানোর সময় বলে দিত, যদি তোমাদেরকে ব্যভিচারের শাস্তি হিসেবে মুখ কালো ও চাবুক মারার কথা বলে তবে তোমরা গ্রহণ করো, আর যদি তোমাদেরকে রজম তথা পাথর মেরে হত্যার কথা বলে তবে সাবধান হয়ে যাবে, অর্থাৎ তা গ্রহণ করো না। [মুসলিম; ১৭০০]
Tafsir Bayaan Foundation
হে রাসূল, তোমাকে যেন তারা চিন্তিত না করে, যারা কুফরে দ্রুত ছুটছে- তাদের থেকে, যারা তাদের মুখে বলে ‘ঈমান এনেছি’ কিন্তু তাদের অন্তর ঈমান আনেনি। আর যারা ইয়াহূদী তারা মিথ্যা অধিক শ্রবণকারী, অন্যান্য কওমের প্রতি, যারা তোমার নিকট আসেনি তাদের পক্ষে তারা কান পেতে থাকে। তারা শব্দগুলোকে যথাযথ সুবিন্যস্ত থাকার পরও আপন স্থান থেকে বিকৃত করে। তারা বলে, ‘যদি তোমাদেরকে এটি প্রদান করা হয়, তবে গ্রহণ কর। আর যদি তা তোমাদেরকে প্রদান না করা হয়, তাহলে বর্জন কর’; আর আল্লাহ যাকে ফিতনায় ফেলতে চান, তুমি তার পক্ষে আল্লাহর বিরুদ্ধে কিছুরই ক্ষমতা রাখ না। এরাই হচ্ছে তারা, যাদের অন্তরসমূহকে আল্লাহ পবিত্র করতে চান না। তাদের জন্য রয়েছে দুনিয়াতে লাঞ্ছনা এবং আখিরাতে তাদের জন্য রয়েছে মহাআযাব।
Muhiuddin Khan
হে রসূল, তাদের জন্যে দুঃখ করবেন না, যারা দৌড়ে গিয়ে কুফরে পতিত হয়; যারা মুখে বলেঃ আমরা মুসলমান, অথচ তাদের অন্তর মুসলমান নয় এবং যারা ইহুদী; মিথ্যাবলার জন্যে তারা গুপ্তচর বৃত্তি করে। তারা অন্যদলের গুপ্তচর, যারা আপনার কাছে আসেনি। তারা বাক্যকে স্বস্থান থেকে পরিবর্তন করে। তারা বলেঃ যদি তোমরা এ নির্দেশ পাও, তবে কবুল করে নিও এবং যদি এ নির্দেশ না পাও, তবে বিরত থেকো। আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করতে চান, তার জন্যে আল্লাহর কাছে আপনি কিছু করতে পারবেন না। এরা এমনিই যে, আল্লাহ এদের অন্তরকে পবিত্র করতে চান না। তাদের জন্যে রয়েছে দুনিয়াতে লাঞ্ছনা এবং পরকালে বিরাট শাস্তি।
Zohurul Hoque
হে প্রিয় রসূল! যারা অবিশ্বাসের অভিমুখে ধাওয়া করেছে তারা যেন তোমাকে দুঃখিত না করে, যারা তাদের মুখে বলে -- 'আমরা ঈমান এনেছি’, কিন্তু তাদের হৃদয় ঈমান আনে নি, আর যারা ইহুদীয় মত পোষণ করে, -- মিথ্যার জন্যে শ্রবণকারী, শ্রবণকারী অন্য লোকদের জন্যে যারা তোমার কাছে আসে না। তারা কথাগুলো সরিয়ে দেয় সেগুলোকে যথাস্থানে স্থাপনের পরে, তারা বলে -- ''তোমাদের যদি এই দেওয়া হয় তবে তা গ্রহণ করো, আর যদি তোমাদের এই দেয়া না হয় তবে সাবধান হও।’’ আর যাকে তার প্রলোভনের মধ্যে আল্লাহ্ চান, তার জন্য আল্লাহ্র কাছ থেকে কিছু করার ক্ষমতা তোমার নেই। এরাই তারা যাদের সন্বন্ধে আল্লাহ্ চান না যে তাদের হৃদয় বিশুদ্ধ হোক। এদের জন্য এই দুনিয়াতে রয়েছে দুর্গতি, আর পরকালে এদের জন্য কঠোর শাস্তি।