Skip to content

কুরআন মজীদ সূরা আল মায়িদাহ আয়াত ২

Qur'an Surah Al-Ma'idah Verse 2

আল মায়িদাহ [৫]: ২ ~ শব্দ অনুবাদ দ্বারা শব্দ

يٰٓاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا لَا تُحِلُّوْا شَعَاۤىِٕرَ اللّٰهِ وَلَا الشَّهْرَ الْحَرَامَ وَلَا الْهَدْيَ وَلَا الْقَلَاۤىِٕدَ وَلَآ اٰۤمِّيْنَ الْبَيْتَ الْحَرَامَ يَبْتَغُوْنَ فَضْلًا مِّنْ رَّبِّهِمْ وَرِضْوَانًا ۗوَاِذَا حَلَلْتُمْ فَاصْطَادُوْا ۗوَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَاٰنُ قَوْمٍ اَنْ صَدُّوْكُمْ عَنِ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ اَنْ تَعْتَدُوْۘا وَتَعَاوَنُوْا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوٰىۖ وَلَا تَعَاوَنُوْا عَلَى الْاِثْمِ وَالْعُدْوَانِ ۖوَاتَّقُوا اللّٰهَ ۗاِنَّ اللّٰهَ شَدِيْدُ الْعِقَابِ (المائدة : ٥)

yāayyuhā
يَٰٓأَيُّهَا
O you
হে
alladhīna
ٱلَّذِينَ
who
যারা
āmanū
ءَامَنُوا۟
believe!
ঈমান এনেছো
لَا
(Do) not
না
tuḥillū
تُحِلُّوا۟
violate
তোমরা বৈধ মনে করো
shaʿāira
شَعَٰٓئِرَ
(the) rites
নিদর্শনসমূহকে
l-lahi
ٱللَّهِ
(of) Allah
আল্লাহর
walā
وَلَا
and not
এবং না (বৈধ করো)
l-shahra
ٱلشَّهْرَ
the month
মাসকে
l-ḥarāma
ٱلْحَرَامَ
the sacred
পবিত্র
walā
وَلَا
and not
এবং না (হাত লাগাবে)
l-hadya
ٱلْهَدْىَ
the sacrificial animals
কুরবানির জন্যে কাবায় পাঠানো পশুকে
walā
وَلَا
and not
এবং না
l-qalāida
ٱلْقَلَٰٓئِدَ
the garlanded
গলায় চিহ্নবিশিষ্ট পশুগুলোকে
walā
وَلَآ
and not
এবং না (কষ্ট দিও)
āmmīna
ءَآمِّينَ
(those) coming
যাত্রীদেরকে
l-bayta
ٱلْبَيْتَ
(to) the House
(অভিমুখী) ঘরের
l-ḥarāma
ٱلْحَرَامَ
the Sacred
পবিত্র
yabtaghūna
يَبْتَغُونَ
seeking
সন্ধান করছে তারা
faḍlan
فَضْلًا
Bounty
অনুগ্রহ
min
مِّن
of
পক্ষ থেকে
rabbihim
رَّبِّهِمْ
their Lord
রবের তাদের
wariḍ'wānan
وَرِضْوَٰنًاۚ
and good pleasure
ও সন্তুষ্টি
wa-idhā
وَإِذَا
And when
এবং যখন
ḥalaltum
حَلَلْتُمْ
you come out of Ihram
ইহরাম মুক্ত হবে তোমরা
fa-iṣ'ṭādū
فَٱصْطَادُوا۟ۚ
then (you may) hunt
তখন তোমরা শিকার করতে পারো
walā
وَلَا
And let not
এবং না (যেন)
yajrimannakum
يَجْرِمَنَّكُمْ
incite you
প্ররোচিত করে তোমাদেরকে
shanaānu
شَنَـَٔانُ
(the) hatred
বিদ্বেষ
qawmin
قَوْمٍ
(for) a people
কোনো সম্প্রদায়ের
an
أَن
as
(এ কারণে) যে
ṣaddūkum
صَدُّوكُمْ
they stopped you
তারা বাধা দেয় তোমাদের
ʿani
عَنِ
from
হতে
l-masjidi
ٱلْمَسْجِدِ
Al-Masjid
মসজীদে
l-ḥarāmi
ٱلْحَرَامِ
Al-Haraam
হারাম
an
أَن
that
(এতদূর) যে
taʿtadū
تَعْتَدُواۘ
you commit transgression
তোমরা সীমালংঘন করে বসো
wataʿāwanū
وَتَعَاوَنُوا۟
And help one another
এবং তোমরা সহযোগিতা করবে
ʿalā
عَلَى
in
ব্যাপারে
l-biri
ٱلْبِرِّ
[the] righteousness
সৎকর্মের
wal-taqwā
وَٱلتَّقْوَىٰۖ
and [the] piety
ও তাকওয়ার
walā
وَلَا
but (do) not
কিন্তু না
taʿāwanū
تَعَاوَنُوا۟
help one another
তোমরা সহযোগিতা করবে
ʿalā
عَلَى
in
ব্যাপারে
l-ith'mi
ٱلْإِثْمِ
[the] sin
পাপের
wal-ʿud'wāni
وَٱلْعُدْوَٰنِۚ
and [the] transgression
ও সীমালংঘনের
wa-ittaqū
وَٱتَّقُوا۟
And fear
এবং তোমরা ভয় করো
l-laha
ٱللَّهَۖ
Allah
আল্লাহকে
inna
إِنَّ
indeed
নিশ্চয়ই
l-laha
ٱللَّهَ
Allah
আল্লাহ
shadīdu
شَدِيدُ
(is) severe
কঠোর
l-ʿiqābi
ٱلْعِقَابِ
(in) [the] punishment
শাস্তিদানে

Transliteration:

Yaaa aiyuhal lazeena aamanoo laa tuhilloo sha'aaa 'iral laahi wa lash Shahral Haraama wa lal hadya wa lal qalaaa'ida wa laa aaammeenal Baital Haraama yabtaghoona fadlam mir Rabbihim wa ridwaanaa; wa izaa halaltum fastaadoo; wa laa yajrimannakum shana aanu qawmin an saddookum 'anil Masjidil-Haraami an ta'tadoo; wa ta'aawanoo 'alalbirri wattaqwaa; wa laa ta'aawanoo 'alal ismi wal'udwaan; wattaqul laah; innal laaha shadeedul 'iqaab (QS. al-Māʾidah:2)

English Sahih International:

O you who have believed, do not violate the rites of Allah or [the sanctity of] the sacred month or [neglect the marking of] the sacrificial animals and garlanding [them] or [violate the safety of] those coming to the Sacred House seeking bounty from their Lord and [His] approval. But when you come out of ihram, then [you may] hunt. And do not let the hatred of a people for having obstructed you from al-Masjid al-Haram lead you to transgress. And cooperate in righteousness and piety, but do not cooperate in sin and aggression. And fear Allah; indeed, Allah is severe in penalty. (QS. Al-Ma'idah, Ayah ২)

তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):

ওহে মু’মিনগণ! আল্লাহর নিদর্শনাবলীর, হারাম মাসের, কা‘বায় প্রেরিত কুরবানীর পশুর এবং গলদেশে মাল্য পরিহিত পশুর অসম্মান করো না, যারা নিজ প্রতিপালকের অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে পবিত্র গৃহের আশ্রয়ে চলেছে তাদেরও (অবমাননা) করো না। তোমরা যখন ইহরামমুক্ত হবে তখন শিকার করতে পার। তোমাদেরকে যারা মসজিদে হারাম থেকে বাধা প্রদান করেছিল, তাদের প্রতি শত্রুতা তোমাদেরকে যেন অবশ্যই সীমালঙ্ঘনে প্ররোচিত না করে। সৎকাজ ও তাক্বওয়ার ব্যাপারে তোমরা পরস্পরকে সহযোগিতা কর, পাপ ও সীমালঙ্ঘনের কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা করো না। আল্লাহকে ভয় কর, আল্লাহ শাস্তি দানে অত্যন্ত কঠোর। (আল মায়িদাহ, আয়াত ২)

Tafsir Ahsanul Bayaan

হে বিশ্বাসীগণ! আল্লাহর নিদর্শনের,[১] পবিত্র মাসের,[২] হজ্জে যবেহযোগ্য কুরবানীর পশু, গলদেশে কিছু বেঁধে চিহ্নিত করে কুরবানীর জন্য কা’বায় প্রেরিত পশুর[৩] এবং নিজ প্রতিপালকের অনুগ্রহ ও সন্তোষ লাভের আশায় পবিত্র গৃহ-অভিমুখীদের[৪] পবিত্রতার অবমাননা করো না। যখন তোমরা ইহরাম-মুক্ত হবে তখন শিকার করতে পার।[৫] তোমাদেরকে পবিত্র মসজিদে বাধা দেবার ফলে কোন সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদেরকে যেন কখনই সীমালংঘনে প্ররোচিত না করে।[৬] সৎ কাজ ও আত্মসংযমে তোমরা পরস্পর সহযোগিতা কর এবং পাপ ও সীমালংঘনের কাজে একে অন্যের সাহায্য করো না।[৭] আর আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তিদানে অতি কঠোর।

[১] شعائر শব্দটি شعيرة এর বহুবচন। যার ভাবার্থ, আল্লাহর পক্ষ থেকে নিষিদ্ধ ও সম্মানীয় বস্তুসমূহ। (অর্থাৎ, যাদের মর্যাদা ও সম্মান আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত)। কিছু উলামাগণ মনে করেন যে, এই মর্যাদাযোগ্য ও সম্মানীয় বস্তুগুলি ব্যাপক। কিছু উলামাগণের নিকট হজ্জ ও উমরার ইবাদত ও স্থানসমূহ উদ্দিষ্ট। অর্থাৎ, তার অমর্যাদা ও অসম্মান করো না। অনুরূপ হজ্জ ও উমরাহ পালনের ব্যাপারে অপরকে বাধা দিয়ো না। কেননা এটাও এক প্রকার অমর্যাদা ও অসম্মান প্রদর্শন।

[২] الشهر الحرام একবচন বলে শ্রেণী উদ্দেশ্য। অর্থাৎ, নিষিদ্ধ, পবিত্র বা সম্মানীয় শ্রেণীর চারটি মাস (অর্থাৎ, রজব, যুল-ক্বা'দাহ, যুল-হিজ্জাহ ও মুহার্রম) এই মাসগুলির মর্যাদা ও সম্মান রক্ষা কর এবং তাতে যুদ্ধ-বিগ্রহ করো না। কেউ কেউ মনে করেন যে, নিষিদ্ধ ও সম্মানীয় মাস শুধু যুল-হিজ্জাহ মাস। আবার কেউ মনে করেন যে, উক্ত নির্দেশ কুরআনের এই আয়াত {فَاقْتُلُواْ الْمُشْرِكِينَ حَيْثُ وَجَدتُّمُوهُمْ} (অর্থাৎ, মুশরিকদেরকে যখন যেথায় পাবে হত্যা কর) দ্বারা রহিত হয়ে গেছে। অথচ রহিত মনে করার কোন প্রয়োজনই হয় না। কারণ, উভয় নির্দেশ নিজ নিজ জায়গায় বহাল আছে; উভয়ের মধ্যে কোন রকম পরস্পরবিরোধ নেই।

[৩] هَدْيٌ হাদ্ঈ ঐ পশুকে বলা হয়, যাকে কুরবানী দেওয়ার জন্য হাজীগণ সঙ্গে করে হারামে নিয়ে যেতেন । قلائد শব্দটি قلادة শব্দের বহুবচন। যার অর্থ গলায় ঝুলানো কিছু। আর এখানে হজ্জ ও উমরাহর সময় কুরবানীযোগ্য পশুকে বুঝানো হয়েছে, যাদের গলায় আলামত ও চিহ্নের জন্য জুতা বা ফিতা বেঁধে দেওয়া হত। (যাতে লোকে বুঝতে পারে যে, এটা কুরবানীর পশু)। সুতরাং قلائد এর ভাবার্থ হল, ঐ সমস্ত পশু, যেগুলিকে কুরবানী করার জন্য মক্কার হারামে নিয়ে যাওয়া হয়। এটা 'হাদঈ'র অতিরিক্ত তাকীদ। উদ্দেশ্য হল, ঐ সমস্ত পশুকে কেউ যেন ছিনতাই না করে এবং হারাম পর্যন্ত পৌঁছনোর ব্যাপারে কেউ যেন কোন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি না করে।

[৪] অর্থাৎ, হজ্জ ও উমরাহর নিয়তে কিংবা ব্যবসা বাণিজ্য ও কর্মের উদ্দেশ্যে হারামের যাত্রীদের জন্য প্রতিবন্ধকতা ও সঙ্কীর্ণতার সৃষ্টি করো না। কোন কোন ভাষ্যকারের মন্তব্য হল, এই বিধান ঐ সময়ের জন্য ছিল, যখন মুসলমান ও মুশরিকগণ একত্রে হজ্জ ও উমরাহ পালন করত। কিন্তু যখন এই আয়াত অবতীর্ণ হল; {إِنَّمَا الْمُشْرِكُونَ نَجَسٌ فَلَا يَقْرَبُوا الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ بَعْدَ عَامِهِمْ هَذَا} অর্থাৎ, মুশরিকরা অপবিত্র, সুতরাং তারা যেন এ বছরের পর মাসজিদুল হারামের নিকটবর্তী না হয়। (সূরা তাওবা ৯;২৮ নং আয়াত) তখন এই আয়াত মুশরিকদের ক্ষেত্রে রহিত বা মানসুখ হয়ে গেল। আবার কোন কোন ভাষ্যকারের মতে এই আয়াতের বিধান রহিত নয় এবং এই হুকুম বা বিধান মুসলমানদের জন্য প্রযোজ্য। (অর্থাৎ, তোমরা হারামের মুসলিম যাত্রীদের জন্য প্রতিবন্ধকতার প্রাচীর খাড়া করো না।) (ফাতহুল ক্বাদীর)

[৫] আলোচ্য আয়াতে আজ্ঞাসূচক ক্রিয়াটি অনুমতি বা জায়েযের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে, যার অর্থ; যখন ইহরাম খুলে দেবে (অর্থাৎ হালাল হয়ে যাবে), তখন তোমাদের জন্য শিকার করা বৈধ।

[৬] অর্থাৎ; মুশরিকরা তোমাদেরকে ৬ষ্ঠ হিজরীতে মসজিদে হারামে যেতে বাধা প্রদান করেছিল। কিন্তু তাদের বাধাদানের কারণে তোমরা তাদের সাথে সীমালংঘনমূলক ও অন্যায় আচরণ করবে না। শত্রুদের সাথেও ধৈর্য ও ক্ষমাশীলতা অবলম্বনের সবক ও শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে।

[৭] এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক নীতি, যা প্রত্যেক মুসলিমের প্রতি পদক্ষেপে পথপ্রদর্শন করতে পারে। হায়! মুসলিমরা যদি এই মৌলিক নীতি নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করতে পারত!

Tafsir Abu Bakr Zakaria

হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর নিদর্শনসমূহ [১], পবিত্র মাস, কুরবানীর জন্য কা’বায় পাঠানো পশু, গলায় পরান চিহ্নবিশিষ্ট পশু এবং নিজ রব-এর অনুগ্রহ ও সন্তোষলাভের আশায় পবিত্র ঘর অভিমুখে যাত্রীদেরকে বৈধ মনে করবে না [২]। আর যখন তোমরা ইহরামমুক্ত হবে তখন শিকার করতে পার [৩]। তোমাদেরকে মস্‌জিদুল হালামে প্রবেশে বাঁধা দেয়ার কারণে কোন সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদেরকে যেন কখনই সীমালঙ্ঘনে প্ররোচিত না করে [৪]। নেককাজ ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পর সাহায্য করবে [৫] এবং পাপ ও সীমালংঘনে একে অন্যের সাহায্য করবে না। আর আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর। নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর।

[১] অর্থাৎ হে মুমিনগন, আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অবমাননা করো না। এখানে (شَعَائِر) শব্দটি - (شَعِيْرَةٌ) শব্দের বহুবচন। এর অর্থ, চিহ্ন। যেসব অনুভূত ও প্রত্যক্ষ ক্রিয়াকর্মকে সাধারণের পরিভাষায় মুসলিম হওয়ার চিহ্নরূপে গণ্য করা হয়, সেগুলোকে (شَعَائِرُ الاسْلام) তথা ‘ইসলামের নিদর্শনাবলী’ বলা হয়। যেমন, সালাত, আযান, হজ, দাড়ী ইত্যাদি। অনুরূপভাবে সাফা, মারওয়া, হাদঈ ও কুরবানীর জন্তু ইত্যাদিও আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অন্তর্ভুক্ত। [আত-তাফসীরুস সহীহ] আয়াতে উল্লেখিত ‘আল্লাহর নিদর্শনাবলী’র ব্যাখ্যা বিভিন্ন ভাবে বর্ণিত আছে। সব উক্তির নির্যাস হলো এই যে, আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অর্থ সব শরীআত এবং ধর্মের নির্ধারিত ফরয, ওয়াজিব ও এদের সীমা। [ফাতহুল কাদীর]

আলোচ্য আয়াতের সারমর্ম এই যে, আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অবমাননা করো না। আল্লাহর নিদর্শনাবলীর এক অবমাননা হচ্ছে, প্রথমতঃ এসব বিধি-বিধানকে উপেক্ষা করে চলা। দ্বিতীয়তঃ এসব বিধি-বিধানকে অসম্পূর্ণভাবে পালন করা এবং তৃতীয়তঃ নির্ধারিত সীমালঙ্ঘন করে সম্মুখে অগ্রসর হওয়া। আয়াতে এ তিন প্রকার অবমাননাকেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। [সা’দী] আল্লাহ তা’আলা এ নির্দেশটিই অন্যস্থানে এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ “যে ব্যক্তি আল্লাহর নিদর্শনাবলীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে, তা অন্তরের তাকওয়ারই লক্ষণ”। [সূরা আল-হাজ; ৩২] তাছাড়া আয়াতের বাকী অংশে এ নিদর্শণাবলীর কিছু বিবরণ প্রদান করা হয়েছে।

[২] অর্থাৎ পবিত্র মাসসমূহে যুদ্ধ-বিগ্রহ করে এগুলোর অবমাননা করো না। [আততাফসীরুস সহীহ] পবিত্র মাস হচ্ছে জিলকদ, জিলহজ, মুহাররাম ও রজব। এসব মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ করা শরীআতের আইনে অবৈধ ছিল। অধিকাংশ আলেমের মতে পরবর্তী কালে এ নির্দেশ রহিত হয়ে গেছে। কিন্তু প্রখ্যাত তাবেয়ী ইমাম আতা, শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ এবং ইবনুল কাইয়্যেম মনে করেন যে, এ আদেশ রহিত হয় নি। যদি কেউ আক্রমণ করে বা যুদ্ধ এর আগে থেকেই চলে আসে তবে এ মাসে যুদ্ধ করা যাবে, নতুবা নয়। [সা’দী, ইবন কাসীর]

এ আয়াতে পরবর্তী নির্দেশ হচ্ছে, কুরবানী করার জন্তু, বিশেষতঃ যেসব জন্তুকে গলায় কুরবানীর চিহ্নস্বরূপ কিছু পরানো হয়েছে, সেগুলোর অবমাননা করো না। এসব জন্তুর অবমাননার এক পন্থা হচ্ছে এদের হারাম পর্যন্ত পৌছতে না দেয়া অথবা ছিনিয়ে নেয়া। দ্বিতীয় পন্থা এই যে, এগুলো কুরবানীর পরিবর্তে অন্য কোন কাজে নিয়োজিত করা। আয়াত এসব পস্থাকেই অবৈধ করে দিয়েছে। আয়াতে আরও বলা হয়েছে যে, তোমরা ঐসব লোকেরও অবমাননা করো না, যারা হজের জন্যে পবিত্র মসজিদের উদ্দেশ্যে গৃহত্যাগ করেছে। এ সফরে তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বীয় পালনকর্তার রহমত, দয়া ও সন্তুষ্টি অর্জন করা। অর্থাৎ পথিমধ্যে তাদের গতিরোধ করো না এবং তাদের কোনরূপ কষ্ট দিয়ো না। [সা’দী]

[৩] এখানে ইহরাম অবস্থায় শিকার করতে যে নিষেধ করা হয়েছিল, সে নিষেধাজ্ঞার সীমা বর্ণনা করা হয়েছে যে, যখন তোমরা ইহরাম থেকে মুক্ত হয়ে যাও, তখন শিকার করার নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়ে যাবে। অতএব, তখন শিকারও করতে পারবে। [সা’দী]

[৪] অর্থাৎ যে সম্প্রদায় হুদায়বিয়ার ঘটনার সময় তোমাদের মক্কায় প্রবেশ করতে এবং ওমরা পালন করতে বাধা প্রদান করেছিল এবং তোমরা তীব্র ক্ষোভ ও দুঃখ নিয়ে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে এসেছিলে, এখন শক্তি-সামর্থ্যের অধিকারী হয়ে তোমরা তাদের কাছ থেকে এভাবে প্রতিশোধ নিও না যে, তোমরা তাদের কাবাগৃহে ও পবিত্র মসজিদে প্রবেশ করতে এবং হজ্জ করতে বাধা দিতে শুরু করবে। এটাই হবে যুলুম। আর ইসলাম যুলুমের উত্তরে যুলুম করতে চায় না। বরং ইসলাম যুলুমের প্রতিদানে ইনসাফ এবং ইনসাফে কায়েম থাকার শিক্ষা দেয়। এটাই প্রমাণ করে যে, ইসলাম হক দ্বীন। [আদওয়াউল বায়ান]

[৫] আলোচ্য আয়াতে পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতার ভিত্তি কি হবে সেটা আলোচনা করা হয়েছে। পবিত্র কুরআন সৎকর্ম ও আল্লাহর ভয়কে আসল মাপকাঠি করেছে, এর ভিত্তিতেই পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতার আহবান জানিয়েছে। এর বিপরীতে পাপ ও অত্যাচার উৎপীড়নকে কঠোর অপরাধ গণ্য করেছে এবং এতে সাহায্যসহযোগিতা করতে নিষেধ করেছে। মূলতঃ সৎকর্ম ও তাকওয়াই হলো শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি। কারণ, সমস্ত মানুষ এক পিতা-মাতার সন্তান। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বিষয়টির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বিদায় হজ্জের ভাষণে ঘোষণা করেন যে, ‘কোন আরবের অনারবের উপর অথবা কোন শ্বেতাঙ্গের কৃষ্ণাঙ্গের উপর কোন শ্রেষ্ঠত্ব নাই। আল্লাহ ভীতি ও আল্লাহর আনুগত্যই শ্রেষ্ঠত্বের একমাত্র মাপকাঠি।’ [মুসনাদে আহমাদঃ ৫/৪১১]

আয়াতে বর্ণিত সৎকাজ ও পাপকাজ এর সংজ্ঞায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘বির বা সৎকাজ হচ্ছে, সচ্চরিত্ৰতা। আর পাপ হচ্ছে, যা তোমার অন্তরে উদিত হয় অথচ তুমি চাও না যে, মানুষ সেটা জানুক’। [মুসলিম; ২৫৫৩]

অপর হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘বি’র বা সৎকাজ হচ্ছে, যাতে অন্তর শান্ত হয়, চিত্তে প্রশান্তি লাভ হয়। আর পাপ হচ্ছে, যাতে অন্তরে শান্ত হয় না এবং চিত্তেও প্রশান্তি লাভ হয় না, যদিও ফতোয়াপ্রদানকারীরা তোমাকে ফতোয়া দিয়ে থাকুক’। [মুসনাদে আহমাদ ৪/১৯৪]

আর সহযোগিতার ধরণ সম্পর্কেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেছেন, ‘তুমি তোমার ভাইকে সাহায্য কর, সে অত্যাচারী হোক বা অত্যাচারিত’। সাহাবায়ে কিরাম বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! অত্যাচারিতকে তো আমরা সাহায্য করে থাকি। কিন্তু অত্যাচারীকে কিভাবে সাহায্য করব? রাসূল বললেন, ‘তার দু’হাতে ধরে রাখবে’। [বুখারী; ২৪৪৪]

অপর হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে কেউ কোন মুসলিমের সম্মান-ইজ্জত-আব্রু নষ্ট হওয়া প্রতিরোধ করবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার মুখমণ্ডল থেকে জাহান্নামের আগুন প্রতিরোধ করবেন। [তিরমিয়ী; ১৯৩১; মুসনাদে আহমাদ ৬/৪৫০] তাকওয়া ও বির এর মধ্যে পার্থক্য করে ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, নির্দেশিত বিষয় করার নাম বির, আর নিষেধকৃত বিষয় থেকে বেঁচে থাকার নাম তাকওয়া। [তাবারী]

Tafsir Bayaan Foundation

হে মুমিনগণ, তোমরা অসম্মান করো না আল্লাহর নিদর্শনসমূহের, হারাম মাসের, হারামে প্রেরিত কুরবানীর পশুর, গলায় চি‎হ্ন দেয়া পশুর এবং আপন রবের অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টির অনুসন্ধানে পবিত্র গৃহের অভিমুখীদের। যখন তোমরা হালাল হও, তখন শিকার কর। কোন কওমের শত্রুতা যে, তারা তোমাদেরকে মসজিদে হারাম থেকে বাধা প্রদান করেছে, তোমাদেরকে যেন কখনো প্ররোচিত না করে যে, তোমরা সীমালঙ্ঘন করবে। সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পরের সহযোগিতা কর। মন্দকর্ম ও সীমালঙ্ঘনে পরস্পরের সহযোগিতা করো না। আর আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ আযাব প্রদানে কঠোর।

Muhiuddin Khan

হে মুমিনগণ! হালাল মনে করো না আল্লাহর নিদর্শনসমূহ এবং সম্মানিত মাসসমূহকে এবং হরমে কুরবানীর জন্যে নির্দিষ্ট জন্তুকে এবং ঐসব জন্তুকে, যাদের গলায় কন্ঠাভরণ রয়েছে এবং ঐসব লোককে যারা সম্মানিত গৃহ অভিমুখে যাচ্ছে, যারা স্বীয় পালনকর্তার অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনা করে। যখন তোমরা এহরাম থেকে বের হয়ে আস, তখন শিকার কর। যারা পবিত্র মসজিদ থেকে তোমাদেরকে বাধা প্রদান করেছিল, সেই সম্প্রদায়ের শুত্রুতা যেন তোমাদেরকে সীমালঙ্ঘনে প্ররোচিত না করে। সৎকর্ম ও খোদাভীতিতে একে অন্যের সাহায্য কর। পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করো না। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা কঠোর শাস্তিদাতা।

Zohurul Hoque

ওহে যারা ঈমান এনেছ! আল্লাহ্‌র নিদর্শনসমূহ লঙ্ঘন করো না, আর পবিত্র মাসেরও না, আর উৎসর্গকৃত পশুদেরও না, আর মালা পরানো উটদেরও না, আর পবিত্র গৃহে আশ্রয় গ্রহণকারীদেরও না যারা তাদের প্রভুর কাছ থেকে কৃপা ও সন্তোষ কামনা করছে। কিন্তু যখন তোমরা মুক্ত হয়ে যাও তখন শিকার করো। আর কোনো লোকের প্রতি বিদ্বেষ, যেহেতু তারা হারাম-মসজিদে তোমাদের যেতে বাধা দিয়েছিল, তোমাদের যেন সীমালঙ্ঘনে প্ররোচিত না করে। আর পরস্পরকে সাহায্য করো সৎকাজে ও ভয়-ভক্তিতে, আর পাপাচারে ও উল্লঙ্ঘনে সহায়তা করো না, আর আল্লাহ্‌কে ভয়-ভক্তি করো। নিঃসন্দেহ আল্লাহ্ প্রতিফলদানে কঠোর।