Skip to content

কুরআন মজীদ সূরা আন নিসা আয়াত ৩৬

Qur'an Surah An-Nisa Verse 36

আন নিসা [৪]: ৩৬ ~ শব্দ অনুবাদ দ্বারা শব্দ

۞ وَاعْبُدُوا اللّٰهَ وَلَا تُشْرِكُوْا بِهٖ شَيْـًٔا وَّبِالْوَالِدَيْنِ اِحْسَانًا وَّبِذِى الْقُرْبٰى وَالْيَتٰمٰى وَالْمَسٰكِيْنِ وَالْجَارِ ذِى الْقُرْبٰى وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنْۢبِ وَابْنِ السَّبِيْلِۙ وَمَا مَلَكَتْ اَيْمَانُكُمْ ۗ اِنَّ اللّٰهَ لَا يُحِبُّ مَنْ كَانَ مُخْتَالًا فَخُوْرًاۙ (النساء : ٤)

wa-uʿ'budū
وَٱعْبُدُوا۟
And worship
এবং তোমরা ইবাদাত কর
l-laha
ٱللَّهَ
Allah
আল্লাহর
walā
وَلَا
And (do) not
ও না
tush'rikū
تُشْرِكُوا۟
associate
তোমরা শিরক করো
bihi
بِهِۦ
with Him
তাঁর সাথে
shayan
شَيْـًٔاۖ
anything
কোন কিছুকে
wabil-wālidayni
وَبِٱلْوَٰلِدَيْنِ
and to the parents
ও পিতা মাতার সাথে
iḥ'sānan
إِحْسَٰنًا
(do) good
সৎ ব্যবহার (করবে)
wabidhī
وَبِذِى
and with
এবং সাথে
l-qur'bā
ٱلْقُرْبَىٰ
the relatives
আত্মীয়-স্বজনদের সাথে
wal-yatāmā
وَٱلْيَتَٰمَىٰ
and the orphans
ও ইয়াতীমদের
wal-masākīni
وَٱلْمَسَٰكِينِ
and the needy
ও অভাবগ্রস্তদের
wal-jāri
وَٱلْجَارِ
and the neighbor
ও প্রতিবেশী
dhī
ذِى
(who is)
(চিরকাল)
l-qur'bā
ٱلْقُرْبَىٰ
near
আত্মীয়
wal-jāri
وَٱلْجَارِ
and the neighbor
ও প্রতিবেশী
l-junubi
ٱلْجُنُبِ
(who is) farther away
দূরের (অর্থাৎ অনাত্মীয়ও)
wal-ṣāḥibi
وَٱلصَّاحِبِ
and the companion
ও সাথী
bil-janbi
بِٱلْجَنۢبِ
by your side
পাশাপাশি চলার
wa-ib'ni
وَٱبْنِ
and the
l-sabīli
ٱلسَّبِيلِ
traveler
পথ চারী
wamā
وَمَا
and what
ও যা
malakat
مَلَكَتْ
possess[ed]
মালিক হয়েছে
aymānukum
أَيْمَٰنُكُمْۗ
your right hands
তোমাদের ডান হাত (সবার সাথে ভাল ব্যবহার করবে)
inna
إِنَّ
Indeed
নিশ্চয়ই
l-laha
ٱللَّهَ
Allah
আল্লাহ
لَا
(does) not
না
yuḥibbu
يُحِبُّ
love
পছন্দ করেন
man
مَن
(the one) who
(তাকে) যে
kāna
كَانَ
is
হল
mukh'tālan
مُخْتَالًا
[a] proud
দাম্ভিক
fakhūran
فَخُورًا
(and) [a] boastful
গর্বকারী

Transliteration:

Wa'budul laaha wa laa tushrikoo bihee shai'anw wa bilwaalidaini ihsaananw wa bizil qurbaa walyataamaa walmasaakeeni waljaari zilqurbaa waljaaril junubi wassaahibi biljambi wabnis sabeeli wa maa malakat aimaanukum; innal laaha laa yuhibbu man kaana mukhtaalan fakhooraa (QS. an-Nisāʾ:36)

English Sahih International:

Worship Allah and associate nothing with Him, and to parents do good, and to relatives, orphans, the needy, the near neighbor, the neighbor farther away, the companion at your side, the traveler, and those whom your right hands possess. Indeed, Allah does not like those who are self-deluding and boastful, (QS. An-Nisa, Ayah ৩৬)

তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):

তোমরা আল্লাহর ‘ইবাদাত কর, কিছুকেই তাঁর শরীক করো না এবং মাতা-পিতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম অভাবগ্রস্ত, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, সাথী, মুসাফির এবং তোমাদের আয়ত্তাধীন দাস-দাসীদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ ঐ লোককে ভালবাসেন না, যে অহংকারী, দাম্ভিক। (আন নিসা, আয়াত ৩৬)

Tafsir Ahsanul Bayaan

তোমরা আল্লাহর উপাসনা কর ও কোন কিছুকে তাঁর অংশী করো না এবং পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, পিতৃহীন, অভাবগ্রস্ত, আত্মীয় ও অনাত্মীয় প্রতিবেশী, [১] সঙ্গী-সাথী,[২] পথচারী এবং তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের[৩] প্রতি সদ্ব্যবহার কর। নিশ্চয় আল্লাহ আত্মম্ভরী দাম্ভিককে ভালবাসেন না। [৪]

[১] الْجَارِ الْجُنُبِ (অনাত্মীয় প্রতিবেশী) আত্মীয় প্রতিবেশীর বিপরীতার্থক শব্দ হিসাবে ব্যবহার হয়েছে। এর অর্থ হল, এমন প্রতিবেশী যার সাথে আত্মীয়তার কোন সম্পর্ক নেই। অর্থাৎ, প্রতিবেশীর সাথে প্রতিবেশী হওয়ার কারণে উত্তম ব্যবহার করো। তাতে সে আত্মীয় হোক অথবা না হোক। অনুরূপ হাদীসেও এর প্রতি বড়ই তাকীদ করা হয়েছে।

[২] এ থেকে সফর-সঙ্গী, সহকর্মী, স্ত্রী এবং এমন ব্যক্তিকে বুঝানো হয়েছে, যে কোন লাভের আশায় কারো সাথে নৈকট্য ও ওঠা-বসার সম্পর্ক গড়ে তোলে। বরং এর আওতায় এমন লোকও আসতে পারে, যারা জ্ঞানচর্চা এবং কোন কাজ শেখার জন্য অথবা কোন ব্যবসা বা পেশার খাতিরে আপনার কাছে ওঠা-বসার সুযোগ লাভ করেছে। (ফাতহুল ক্বাদীর)

[৩] এতে ঘরের দাস-দাসী, ভৃত্য-চাকর, দোকানের এবং কারখানা ও মিলের কর্মচারীরাও এসে যায়। ক্রীতদাস-দাসীদের সাথে সদ্ব্যবহার করার বড়ই তাকীদ অনেক হাদীস এসেছে।

[৪] দাম্ভিকতা ও অহংকারকে মহান আল্লাহ চরম ঘৃণা করেন। এমন কি একটি হাদীসে এসেছে যে, "এমন ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণ অহংকার থাকবে।" (মুসলিম ৯১নং) এখানে বিশেষ করে অহংকারের নিন্দা করার উদ্দেশ্য হল, আল্লাহ তাআলার ইবাদত এবং যাদের সাথে সদ্ব্যবহার করার তাকীদ করা হয়েছে, এর উপর আমল কেবল সেই ব্যক্তির পক্ষে করা সম্ভব, যার অন্তর অহংকার থেকে খালি। দাম্ভিক প্রকৃতার্থে না ইবাদতের হক আদায় করতে পারবে, না আপনজন ও অপরজনদের সাথে সদ্ব্যবহার করতে পারবে।

Tafsir Abu Bakr Zakaria

আর তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর ও কোন কিছুকে তাঁর শরীক করো না [১]; এবং পিতা-মাতা [২]; আত্মীয়-স্বজন [৩], ইয়াতীম, অভাবগ্রস্ত [৪], নিকট প্রতিবেশী [৫], দূর-প্রতিবেশী [৬], সঙ্গী-সাথী [৭], মুসাফির [৮] ও তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের [৯] প্রতি সদ্ব্যবহার করো। নিশ্চয় আল্লাহ পছন্দ করেন না দাম্ভিক, অহংকারীকে [১০]।

[১] অর্থাৎ আল্লাহর ইবাদাত কর এবং ইবাদাতের বেলায় তাঁর সাথে অন্য কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করো না। মু’আয ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিছনে তার বাহনে বসা ছিলাম। এমতাবস্থায় তিনি বললেন, তুমি কি জান, বান্দার উপর আল্লাহর কি হক? আমি বললামঃ আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। তিনি বললেনঃ বান্দার উপর আল্লাহর হক হল, একমাত্র তাঁরই ইবাদাত করা। তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরীক না করা। তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো অনেক পথ চলার পর আবার বললেনঃ হে মুআয ইবন জাবাল! তুমি কি জান, বান্দা যদি এ কাজটি করে তাহলে আল্লাহর উপর বান্দার কি হক রয়েছে? আমি বললামঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। তিনি বললেনঃ আল্লাহর উপর বান্দার হক হল, তাদেরকে শাস্তি না দেয়া। [বুখারীঃ ৬৫০০]

[২] আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, তাওহীদের পর সমস্ত আপনজন-আত্মীয় ও সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে পিতা-মাতার অধিকার সর্বাগ্রে। আল্লাহ্ তা’আলা স্বীয় ইবাদাত বন্দেগী ও হকসমূহের পর পরই পিতা-মাতার হক সম্পর্কিত বিবরণ দানের মাধ্যমে ইঙ্গিত করেছেন যে, প্রকৃতপক্ষে সমস্ত নেয়ামত ও অনুগ্রহ একান্তই আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে, কিন্তু বাহ্যিক উপকরণের দিক দিয়ে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, আল্লাহর পরে মানুষের প্রতি সর্বাধিক ইহসান বা অনুগ্রহ থাকে পিতা-মাতার। সাধারণ উপকরণসমূহের মাঝে মানুষের অস্তিত্বের পিছনে পিতা-মাতাই বাহ্যিক কারণ। তাছাড়া জন্ম থেকে যৌবন প্রাপ্তি পর্যন্ত যে সমস্ত কঠিন ও বন্ধুর পথ ও স্তর রয়েছে, পিতা-মাতাই তাকে সেগুলোতে সাহায্য করেন এবং তার প্রতিপালন ও পরিবর্ধনের জামানতদার হয়ে থাকেন। সে জন্যই আল্লাহ তা’আলা অন্যান্য জায়গায়ও পিতামাতার হকসমূহকে তাঁর ইবাদাত ও আনুগত্যের সাথে যুক্ত করে বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছেঃ “আমার এবং তোমার পিতা-মাতার শুকরিয়া আদায় কর”। [সূরা লুকমান; ১৪]

রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীসমূহে যেমন পিতা-মাতার আনুগত্য এবং তাদের সাথে সদ্ব্যবহারের তাকিদ রয়েছে, তেমনিভাবে তার সীমাহীন ফযীলত, মর্তবা ও সওয়াবের কথাও উল্লেখ রয়েছে। এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ্ তা’আলার সন্তুষ্টি পিতার সন্তুষ্টির মধ্যে এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি পিতার অসন্তুষ্টির মধ্যেই নিহিত রয়েছে”। [তিরমিযী; ১৮৯৯]

[৩] এখানে সমস্ত আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার করার তাকিদ দেয়া হয়েছে। কুরআনুল কারীমের প্রসিদ্ধ এক আয়াতে বিষয়টি এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রায়শঃই বিভিন্ন ভাষণের পর তেলাওয়াত করতেন। তা হলো, “আল্লাহ সবার সাথে ন্যায় ও সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিচ্ছেন এবং নির্দেশ দিচ্ছেন আত্মীয়-স্বজনের হক আদায় করার জন্য”। [সূরা আন-নাহল; ৯০]

এতে সামর্থ্যানুযায়ী আত্মীয়-আপনজনদের কায়িক ও আর্থিক সেবা-যত্ন করা, তাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করা এবং তাদের খবরা-খবর নেয়াও অন্তর্ভুক্ত। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সদকার মাল সাধারণ গরীব-মিসকীনকে দান করলে তাতে তো শুধু সদকার সওয়াবই পাওয়া যায়, অথচ তা যদি নিজের রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়-আপনজনকে দান করা হয়, তাহলে তাতে দুটি সওয়াব পাওয়া যায়। একটি হল সদকার সওয়াব এবং আরেকটি হল সেলায়ে-রেহমীর সওয়াব। [মুসনাদে আহমাদ ৪/২১৪, নাসায়ী; ২৫৮২] অর্থাৎ আত্মীয়তার হক আদায় করার সওয়াব।

[৪] অর্থাৎ লাওয়ারিশ তথা অনাথ শিশু এবং অসহায় মানুষের সাহায্য-সহযোগিতাও এমনি গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরী বিবেচনা করবে, যেমন আত্মীয়-আপনজনদের বেলায় করে থাক ।

[৫] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, হে আবু যর, যখন তরকারী রান্না করবে তখন তাতে বেশী পরিমাণে পানি দিও এবং এর দ্বারা তোমার পড়শীর খোজখবর নিও। [মুসলিমঃ ২৬২৫]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, তোমাদের মধ্যে যে আল্লাহ ও শেষ দিবসের উপর ঈমান রাখে সে যেন তার পড়শীর সম্মান করে, তোমাদের মধ্যে যে আল্লাহ ও শেষ দিবসের উপর ঈমান আনে সে যেন তার মেহমানের পুরস্কার দিয়ে তাকে সম্মানিত করে। সাহাবায়ে কিরাম বললেন, মেহমানের পুরস্কার কি? তিনি বললেন, একদিন ও রাত্রি। আর মেহমান তিন দিন এর পরের যা সময় তাতে ব্যয় করা সদকাস্বরূপ। তোমাদের মধ্যে যে আল্লাহ ও শেষ দিনে উপর ঈমান আনে সে যেন ভাল বলে অথবা চুপ থাকে। [বুখারী; ৬০১৯]

অপর হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর নিকট সবচেয়ে উত্তম সংগী হচ্ছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সংগীগণ। আর আল্লাহর নিকট সবচেয়ে উত্তম পড়শী হচ্ছেন ঐ পড়শী, যে তার পড়শীর জন্য উত্তম। [তিরমিযী; ১৯৪৪]

[৬] এ আয়াতে দু’রকমের প্রতিবেশীর কথা বলা হয়েছে। এ উভয় প্রকার প্রতিবেশীর বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে সাহাবায়ে কেরামের বিভিন্ন বর্ণনা রয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, (جَارِذِى القُرْبٰى) বলতে সেসব প্রতিবেশীকে বোঝায়, যারা প্রতিবেশী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আত্মীয়ও বটে। এভাবে এতে দু’টি হক সমন্বিত হয়ে যায়। আর (وَالْجَارِ الْجُنُبِ) বলতে শুধু সে প্রতিবেশীকে বোঝায় যার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই। আর সে জন্যই তার উল্লেখ করা হয়েছে দ্বিতীয় পর্যায়ে । [তাবারী] কোন কোন মনীষী বলেছেন, ‘জারে-যিলকোরবা’ এমন প্রতিবেশীকে বলা হয়, যে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের অন্তর্ভুক্ত এবং মুসলিম। আর ‘জারে-জুনুব’ বলা হয় অমুসলিম প্রতিবেশীকে। কুরআনে ব্যবহৃত শব্দে অবশ্য এ সমুদয় সম্ভাব্যতাই বিদ্যমান। অবশ্য প্রতিবেশী হওয়া ছাড়াও যার অন্যান্য হক রয়েছে, অন্যান্য প্রতিবেশীদের তুলনায় তাকে মর্যাদাগত অগ্রাধিকার দিতে হবে।

[৭] যদিও এর শাব্দিক অর্থ হল সহকর্মী। এতে সেসব সফর সঙ্গীরাও অন্তর্ভুক্ত যারা রেল, জাহাজ, বাস, মোটর প্রভৃতিতে পাশাপাশি বসে ভ্রমণ করে এবং সে সমস্ত লোকও অন্তর্ভুক্ত যারা কোন সাধারণ বা বিশেষ বৈঠক বা অধিবেশনে আপনার সাথে উপবেশন করে থাকে। ইসলামী শরী’আত নিকটবর্তী ও দূরবর্তী স্থায়ী প্রতিবেশীদের অধিকার সংরক্ষণকে যেমন ওয়াজিব করে দিয়েছে, তেমনিভাবে সে ব্যক্তির সাহচর্যের অধিকার বা হককেও অপরিহার্য করে দিয়েছে, যে সামান্য সময়ের জন্য হলেও কোন মজলিস, বৈঠক অথবা সফরের সময় আপনার সমপর্যায়ে উপবেশন করে। তাদের মধ্যে মুসলিম, অমুসলিম, আত্মীয়, অনাত্মীয় সবাই সমান -সবার সাথেই সদ্ব্যবহার করার হেদায়াত করা হয়েছে। এর সর্বনিম্ন পর্যায় হচ্ছে এই যে, আপনার কোন কথায় বা কাজে যেন সে কোন রকম কষ্ট না পায়। এমন কোন কথা বলবেন না, যাতে সে মৰ্মাহত হতে পারে। এমন কোন আচরণ করবেন না, যাতে তার কষ্ট হতে পারে। যেমন, ধুমপান করে তার দিকে ধোঁয়া ছাড়া, পান খেয়ে তার দিকে পিক ফেলা এবং এমনভাবে বসা যাতে তার বসার জায়গা সংকুচিত হয়ে যায় প্রভৃতি। যানবাহনে অন্য কোন যাত্রী পাশে বসতে গেলে এ কথা ভাবা উচিত যে, এখানে তার ততটুকুই অধিকার রয়েছে যতটা রয়েছে আমার। কোন কোন তাফসীরকার বলেছেন, এমন প্রতিটি লোকই ‘সাহেবে-বিল-জাম্ব’-এর অন্তর্ভুক্ত যে কোন কাজে, কোন পেশায় বা কোন বিষয়ে আপনার সাথে জড়িত বা আপনার অংশীদার; তা শিল্প-শ্রমেই হোক অথবা অফিস-আদালতের চাকরিতেই হোক অথবা কোন সফরে বা স্থায়ী বসবাসেই হোক। [রুহুল মা’আনী]

[৮] আয়াতে এমন লোককে বোঝানো হয়েছে যে সফরের অবস্থায় আপনার নিকট এসে উপস্থিত হয় কিংবা আপনার মেহমান হয়ে যায়। যেহেতু এই অজানা-অচেনা লোকটির কোন আত্মীয় বা সম্পৰ্কীয় লোক এখানে উপস্থিত থাকে না, সেহেতু কুরআন ইসলামী তথা মানবীয় সম্পর্কের প্রেক্ষিতে তার হকও আপনার উপর অপরিহার্য বলে সাব্যস্ত করে দিয়েছে। তা হল, সামর্থ্য ও সাধ্যানুযায়ী তার সাথে সদ্ব্যবহার করা।

[৯] এতে অধিকারভুক্ত দাস-দাসীকে বোঝানো হয়েছে। তাদের ব্যাপারেও এ হক সাব্যস্ত ও অপরিহার্য করে দেয়া হয়েছে যে, তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করতে হবে। সাধ্যানুযায়ী তাদের খাওয়া পরার ব্যাপারে কার্পণ্য করবে না। তাছাড়া তাদের সাধ্যের অতিরিক্ত কোন কাজ তাদের দ্বারা করাবে না। এখানে আয়াতের বাক্যগুলো যদিও সরাসরিভাবে অধিকারভুক্ত দাস-দাসীকেই বোঝাচ্ছে, কিন্তু কারণ-উপকরণের সামঞ্জস্য এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিভিন্ন বক্তব্যের ভিত্তিতে আলোচ্য নির্দেশ ও বিধি-বিধান দাস-দাসী, চাকর-চাকরানী ও অন্যান্য কর্মচারীর ক্ষেত্রেও ব্যাপকভাবে প্রযোজ্য। তাদের হকও একই রকম। নির্ধারিত বেতন-ভাতা, খানাপিনা প্রভৃতির ব্যাপারে কার্পণ্য বা বিলম্ব করা যাবে না এবং তাদের উপর সাধ্যাতীত কোন কাজও চাপানো যাবে না। যদি শরীআত মত তাদেরকে পরিচালনা করা হয় তবে তাদের যাবতীয় খরচও সদকার অন্তর্ভুক্ত। এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তুমি নিজে যা খাও তা তোমার জন্য সদকা এবং যা তোমার ছেলেকে খাওয়াও তাও তোমার জন্য সদকা, যা তোমার স্ত্রীকে খাওয়াও তাও তোমার জন্য সদকা। অনুরূপভাবে যা তোমার খাদেমকে খাওয়াও সেটাও তোমার জন্য সদকা হিসাবে গণ্য হবে। [মুসনাদে আহমাদঃ ৪/১৩১]

অপর বর্ণনায় এসেছে, মা’রূর ইবন সা’য়ীদ বলেন, আমি আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহুর গায়ে একটি চাদর দেখলাম, অনুরূপ আরেকটি চাদর তার দাসের গায়ে দেখলাম। এ ব্যাপারে আমরা আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, একদিন এক লোককে গালি দিয়েছিলাম। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এ ব্যাপারে গালি দিলে রাসূল আমাকে বললেন, তুমি কি তাকে তার মায়ের ব্যাপার উল্লেখ করে অপমান করলে? তারপর তিনি বললেন, “এরা তোমাদের ভাই, তোমাদের অনুগামী। আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকে তোমাদের কর্তৃত্বাধীন করেছেন। অতএব যার কোন ভাই তার কর্তৃত্বাধীন থাকে, তবে সে যা খায় তা থেকে যেন তাকে খাওয়ায়, যা পরিধান করে তা থেকে যেন তাকে পরিধান করায়। তাদের সাধ্যের অতিরিক্ত কোন দায়িত্ব তাদেরকে দিবে না, যদি সাধ্যের অতিরিক্ত কোন দায়িত্ব দাও তবে তাদেরকে সাহায্য কর।” [বুখারী; ২৫৪৫; মুসলিম; ১৬৬২]

[১০] আল্লাহ্‌ এমন লোককে পছন্দ করেন না, যে দাম্ভিক এবং নিজেকে অন্যের চাইতে বড় প্রতিপন্ন করে। আয়াতের এই শেষ বাক্যটি পূর্ববর্তী সমস্ত বক্তব্যের উপসংহার। কারণ, পূর্ববতী আটটি পর্যায়ে যে সমস্ত লোকের হক সম্পর্কে তাকীদ করা হয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে সে সমস্ত লোকই শৈথিল্য প্রদর্শন করে যাদের মন-মানসিকতায় আত্মগৰ্ব, অহমিকা, তাকাববুর ও দাম্ভিকতা বিদ্যমান। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সাহাবীকে ওসীয়ত করে বলেছেনঃ কাউকে গালি দিও না। সাহাবী বললেনঃ এরপর আমি কোন স্বাধীন, দাস, উট বা ছাগল কাউকেই গালি দেইনি। তিনি আরো বললেনঃ সামান্য কোন নেক কাজকেও হেয় করে দেখবে না যদিও তোমার কোন ভাইয়ের সাথে হাসি মুখে কথা বলা হোক। আর তোমার কাপড়কে টাখনুর অর্ধেক পর্যন্ত উঠাবে, যদি তা করতে না চাও তবে দুই গিরা পর্যন্ত নামাতে পার। কাপড়কে ‘ইসবাল’ বা গিরার নীচে পরা সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ কর। কেননা, এটাই অহংকারের চিহ্ন। আল্লাহ তা’আলা অহংকারীকে পছন্দ করেন না। যদি কোন লোক তোমাকে গালি দেয় অথবা তোমার কোন ক্রটি জানতে পেরে তা নিয়ে উপহাস করে, তুমি তার সেরকম কিছু জেনেও তাকে উপহাস করো না। কারণ, এর প্রতিফল তাকেই ভোগ করতে হবে। [আবু দাউদঃ ৪০৮৪, তিরমিযীঃ ২৭২২]

Tafsir Bayaan Foundation

তোমরা ইবাদাত কর আল্লাহর, তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করো না। আর সদ্ব্যবহার কর মাতা-পিতার সাথে, নিকট আত্মীয়ের সাথে, ইয়াতীম, মিসকীন, নিকট আত্মীয়- প্রতিবেশী, অনাত্মীয়- প্রতিবেশী, পার্শ্ববর্তী সাথী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাভুক্ত দাস-দাসীদের সাথে। নিশ্চয় আল্লাহ পছন্দ করেন না তাদেরকে যারা দাম্ভিক, অহঙ্কারী।

Muhiuddin Khan

আর উপাসনা কর আল্লাহর, শরীক করো না তাঁর সাথে অপর কাউকে। পিতা-মাতার সাথে সৎ ও সদয় ব্যবহার কর এবং নিকটাত্নীয়, এতীম-মিসকীন, প্রতিবেশী, অসহায় মুসাফির এবং নিজের দাস-দাসীর প্রতিও। নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না দাম্ভিক-গর্বিতজনকে।

Zohurul Hoque

আর আল্লাহ্‌র এবাদত করো, আর তাঁর সাথে অন্য কিছু শরিক করো না, আর পিতামাতার প্রতি সদয় আচরণ করো, আর নিকটা‌ত্মীয়দের প্রতি, আর এতীমদের আর মিসকিনদের, আর নিকট সম্পর্কের প্রতিবেশীর, আর পরকীয় প্রতিবেশীর, আর পার্শ্ববর্তী সাথীর, আর পথচারীর, আর যাকে তোমাদের ডান হাত ধরে রেখেছে। নিঃসন্দেহ আল্লাহ্ ভালোবাসেন না তাকে যে দাম্ভিক, গর্বিত, --