কুরআন মজীদ সূরা আন নিসা আয়াত ১৭১
Qur'an Surah An-Nisa Verse 171
আন নিসা [৪]: ১৭১ ~ শব্দ অনুবাদ দ্বারা শব্দ
يٰٓاَهْلَ الْكِتٰبِ لَا تَغْلُوْا فِيْ دِيْنِكُمْ وَلَا تَقُوْلُوْا عَلَى اللّٰهِ اِلَّا الْحَقَّۗ اِنَّمَا الْمَسِيْحُ عِيْسَى ابْنُ مَرْيَمَ رَسُوْلُ اللّٰهِ وَكَلِمَتُهٗ ۚ اَلْقٰهَآ اِلٰى مَرْيَمَ وَرُوْحٌ مِّنْهُ ۖفَاٰمِنُوْا بِاللّٰهِ وَرُسُلِهٖۗ وَلَا تَقُوْلُوْا ثَلٰثَةٌ ۗاِنْتَهُوْا خَيْرًا لَّكُمْ ۗ اِنَّمَا اللّٰهُ اِلٰهٌ وَّاحِدٌ ۗ سُبْحٰنَهٗٓ اَنْ يَّكُوْنَ لَهٗ وَلَدٌ ۘ لَهٗ مَا فِى السَّمٰوٰتِ وَمَا فِى الْاَرْضِۗ وَكَفٰى بِاللّٰهِ وَكِيْلًا ࣖ (النساء : ٤)
- yāahla
- يَٰٓأَهْلَ
- O People
- হে আহলি
- l-kitābi
- ٱلْكِتَٰبِ
- (of) the Book!
- কিতাব
- lā
- لَا
- (Do) not
- না
- taghlū
- تَغْلُوا۟
- commit excess
- তোমরা বাড়াবাড়ি করো
- fī
- فِى
- in
- ব্যাপারে
- dīnikum
- دِينِكُمْ
- your religion
- তোমাদের দ্বীনের
- walā
- وَلَا
- and (do) not
- এবং না
- taqūlū
- تَقُولُوا۟
- say
- তোমরা বলো
- ʿalā
- عَلَى
- about
- উপর
- l-lahi
- ٱللَّهِ
- Allah
- আল্লাহর
- illā
- إِلَّا
- except
- এছাড়া যা
- l-ḥaqa
- ٱلْحَقَّۚ
- the truth
- হক
- innamā
- إِنَّمَا
- Only
- মূলত
- l-masīḥu
- ٱلْمَسِيحُ
- the Messiah
- মসীহ
- ʿīsā
- عِيسَى
- Isa
- ঈসা
- ub'nu
- ٱبْنُ
- son
- পুত্র
- maryama
- مَرْيَمَ
- (of) Maryam
- মারইয়ামের
- rasūlu
- رَسُولُ
- (was) a Messenger
- (তিনি ছিলেন) রাসূল
- l-lahi
- ٱللَّهِ
- (of) Allah
- আল্লাহর
- wakalimatuhu
- وَكَلِمَتُهُۥٓ
- and His word
- ও তাঁর ফরমান
- alqāhā
- أَلْقَىٰهَآ
- which He conveyed
- যা তিনি প্রেরণ করেন
- ilā
- إِلَىٰ
- to
- প্রতি
- maryama
- مَرْيَمَ
- Maryam
- মারইয়ামের
- warūḥun
- وَرُوحٌ
- and a spirit
- ও রূহ
- min'hu
- مِّنْهُۖ
- from Him
- তাঁর পক্ষ হতে
- faāminū
- فَـَٔامِنُوا۟
- So believe
- তোমরা অতএব ঈমান আন
- bil-lahi
- بِٱللَّهِ
- in Allah
- আল্লাহর উপর
- warusulihi
- وَرُسُلِهِۦۖ
- and His Messengers
- ও তাঁর রাসূলদের (উপর)
- walā
- وَلَا
- And (do) not
- এবং না
- taqūlū
- تَقُولُوا۟
- say
- তোমরা বলো
- thalāthatun
- ثَلَٰثَةٌۚ
- "Three"
- ''তিন (ইলাহ)''
- intahū
- ٱنتَهُوا۟
- desist
- তোমরা বিরত হও
- khayran
- خَيْرًا
- (it is) better
- (এটাই) উত্তম
- lakum
- لَّكُمْۚ
- for you
- তোমাদের জন্য
- innamā
- إِنَّمَا
- Only
- মূলত
- l-lahu
- ٱللَّهُ
- Allah
- আল্লাহ
- ilāhun
- إِلَٰهٌ
- (is) God
- ইলাহ
- wāḥidun
- وَٰحِدٌۖ
- One
- একই
- sub'ḥānahu
- سُبْحَٰنَهُۥٓ
- Glory be to Him!
- তিনি পবিত্র
- an
- أَن
- That
- (এ হতে) যে
- yakūna
- يَكُونَ
- He (should) have
- হবে
- lahu
- لَهُۥ
- for Him
- তার
- waladun
- وَلَدٌۘ
- a son
- কোন সন্তান
- lahu
- لَّهُۥ
- To Him (belongs)
- তারই
- mā
- مَا
- whatever
- যা কিছু আছে
- fī
- فِى
- (is) in
- মধ্যে
- l-samāwāti
- ٱلسَّمَٰوَٰتِ
- the heavens
- আসমানসমূহের
- wamā
- وَمَا
- and whatever
- ও যা কিছু (আছে)
- fī
- فِى
- (is) in
- মধ্যে
- l-arḍi
- ٱلْأَرْضِۗ
- the earth
- পৃথিবীর
- wakafā
- وَكَفَىٰ
- And is sufficient
- এবং যথেষ্ট
- bil-lahi
- بِٱللَّهِ
- Allah
- আল্লাহই
- wakīlan
- وَكِيلًا
- (as) a Disposer of affairs
- কর্মবিধায়ক হিসেবে
Transliteration:
Yaaa Ahlal Kitaabi laa taghloo fee deenikum wa laa taqooloo 'alal laahi illalhaqq; innamal Maseehu 'Eesab-nu-Maryamma Rasoolul laahi wa Kalimatuhooo alqaahaaa ilaa Maryamma wa roohum minhum fa aaminoo billaahi wa Rusulihee wa laa taqooloo salaasah; intahoo khairallakum; innamal laahu Ilaahunw Waahid, Subhaanahooo ani yakoona lahoo walad; lahoo maa fissamaawaati wa maa fil ard; wa kafaa billaahi Wakeelaa(QS. an-Nisāʾ:171)
English Sahih International:
O People of the Scripture, do not commit excess in your religion or say about Allah except the truth. The Messiah, Jesus the son of Mary, was but a messenger of Allah and His word which He directed to Mary and a soul [created at a command] from Him. So believe in Allah and His messengers. And do not say, "Three"; desist – it is better for you. Indeed, Allah is but one God. Exalted is He above having a son. To Him belongs whatever is in the heavens and whatever is on the earth. And sufficient is Allah as Disposer of affairs. (QS. An-Nisa, Ayah ১৭১)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
ওহে কিতাবধারীগণ! তোমরা তোমাদের দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না, আর আল্লাহ সম্বন্ধে সত্য ছাড়া কিছু বলো না, ঈসা মাসীহ তো আল্লাহর রসূল আর তাঁর বানী যা তিনি মারইয়ামের নিকট প্রেরণ করেছিলেন, আর তাঁর পক্ষ হতে নির্দেশ, কাজেই তোমরা আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রসূলগণের প্রতি ঈমান আনো, আর বলো না ‘তিন’ (জন ইলাহ আছে), নিবৃত্ত হও, তা হবে তোমাদের জন্য কল্যাণকর, আল্লাহ তো একক ইলাহ, তিনি পবিত্র এত্থেকে যে, তাঁর সন্তান হবে। আসমানসমূহে আর যমীনে যা আছে সব কিছু তাঁরই, আর কর্মবিধায়ক হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট। (আন নিসা, আয়াত ১৭১)
Tafsir Ahsanul Bayaan
হে গ্রন্থধারিগণ! তোমরা ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না[১] এবং আল্লাহ সম্বন্ধে সত্য ছাড়া (মিথ্যা) বলো না। মারয়্যাম-তনয় ঈসা মসীহ তো আল্লাহর রসূল এবং তাঁর বাণী; যা তিনি মারয়্যামের মাঝে প্রক্ষেপ করেছিলেন ও তাঁরই তরফ হতে সমাগত আত্মা।[২] সুতরাং তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলে বিশ্বাস কর এবং বলো না যে, ‘(আল্লাহ) তিনজন।’[৩] তোমরা নিবৃত্ত হও, তোমাদের মঙ্গল হবে। আল্লাহই তো একমাত্র উপাস্য, তাঁর সন্তান হবে --এ হতে তিনি পবিত্র। আকাশ ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে সব তাঁরই। আর কর্মবিধায়ক হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট।
[১] غُلُوْ (অতিরঞ্জন বা বাড়াবাড়ি) শব্দের তাৎপর্য হল, কোন বস্তুকে তার নির্ধারিত সীমা থেকে বাড়িয়ে দেওয়া। যেমন খ্রিষ্টানরা ঈসা (আঃ) ও তাঁর মা মারয়্যাম ('আলাইহাস্ সালাম)-কে ভক্তি-শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করতে করতে তাঁদেরকে রিসালাত ও বান্দার স্থান থেকে উপরে তুলে আল্লাহর আসনে বসিয়ে দিয়েছে এবং যথারীতি তাঁদের ইবাদত করছে। ঠিক এমনিভাবেই ঈসা (আঃ)-এর শিষ্য ও সহচরদের ব্যাপারেও তারা অতিরঞ্জিত করেছে, তাঁদেরকে নিষ্পাপ বলেছে এবং কোন জিনিসকে হারাম ও হালাল করার ব্যাপারে পূর্ণ এখতিয়ার প্রদান করেছে। যেমন মহান আল্লাহ বলেছেন, {اتَّخَذُواْ أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِّن دُونِ اللّه} অর্থাৎ, তারা আল্লাহকে ছেড়ে দিয়ে তাদের পন্ডিত-পুরোহিতগণকে প্রভু বানিয়ে নিয়েছে। (সূরা তাওবাহ ৯;৩১) আল্লাহর আসনে বসানোর সারকথা হচ্ছে, তাদের (পুরোহিতগণ কর্তৃক) হালালকৃত জিনিসকে হালাল এবং হারামকৃত জিনিসকে হারাম বলে মেনে নেওয়া। অথচ এ বিষয়ে পরিপূর্ণ অধিকার একমাত্র আল্লাহর। কিন্তু আহলে কিতাবরা এই অধিকারও তাদের পন্ডিত-পুরোহিতগণকে প্রদান করেছে। আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা আহলে কিতাবদেরকে ধর্মীয় ব্যাপারে বাড়াবাড়ি ও অতিরঞ্জন করতে নিষেধ করেছেন। অনুরূপ মহানবী (সাঃ)ও খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় ব্যাপারে অতিরঞ্জন করা দেখে স্বীয় উম্মতকে এহেন ভয়াবহ মহামারীর কবল হতে রক্ষা করার জন্য পূর্ণ সতর্ক করেছেন। তিনি বলেছেন, "তোমরা আমার প্রশংসা করতে গিয়ে এমন অতিরঞ্জন করবে না, যেমন খ্রিষ্টানরা ঈসা বিন মারয়্যামের ব্যাপারে করেছে। যেহেতু আমি আল্লাহর বান্দাই, সেহেতু তোমরা আমাকে আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রসূল বল। (বুখারীঃ আম্বিয়া অধ্যায়, আহমাদ ১/২৩, ১/১৫৩) কিন্তু বড় পরিতাপ ও দুঃখের বিষয় এই যে, (সতর্কবাণী থাকতেও) উম্মতে মুহাম্মাদীর দাবীদারগণও এই মহামারীর কবল থেকে রেহাই পেল না; যাতে খ্রিষ্টানরা আক্রান্ত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এ উম্মত তার নবীর ব্যাপারেই বাড়াবাড়ি ও অতিরঞ্জন করে ক্ষান্ত হয়নি; বরং নেক বান্দাদেরকেও আল্লাহর গুণে গুণান্বিত করেছে; যা আসলে খ্রিষ্টানদেরই আচরণ ছিল। অনুরূপভাবে উলামা ও ফুক্বাহাগণ, যাঁরা দ্বীনের ব্যাখ্যাতা ও ভাষ্যকার ছিলেন, তাঁদেরকে শরীয়ত রচনার অধিকার প্রদান করেছে। (فإنا لله وإنا إليه راجعون) মহানবী (সাঃ) সত্যই বলেছেন, "যেমন একটি জুতার অপর জুতার সাথে অবিকল মিল থাকে, অনুরূপ তোমরাও পূর্ববর্তী উম্মতের অবিকল অনুকরণ ও অনুসরণ করবে।" অর্থাৎ প্রত্যেক কাজে তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে।
[২] كلمة الله (আল্লাহর বাণী বা শব্দ)এর ব্যাখ্যা হচ্ছে, كن (হও) শব্দ। যার দ্বারা আল্লাহর নির্দেশে বিনা পিতায় ঈসা (আঃ) জন্মলাভ করেন। মহান আল্লাহ এ শব্দটি জিবরীল (আঃ)-এর মাধ্যমে মারয়্যাম ('আলাইহাস্ সালাম)এর কাছে পৌঁঁছে দিয়েছিলেন। روح الله এর অর্থ হচ্ছে, সেই 'ফুঁক' যা আল্লাহর নির্দেশে জিবরীল (আঃ)মারয়্যাম ('আলাইহাস্ সালাম)এর কামীসের গলার নিকট খোলা অংশে ফুঁকেছিলেন, যেটাকে মহান আল্লাহ তাঁর অসীম শক্তিতে পিতার বীর্যের বিকল্প উপাদানে পরিণত করেন। সুতরাং ঈসা (আঃ) হচ্ছেন আল্লাহর কালেমা (বাণী); যা ফিরিশতা দ্বারা মারয়্যাম ('আলাইহাস্ সালাম)এর নিকট পৌঁছে দেন এবং তিনি তাঁর 'রূহ' বা ফুঁকও; যা জিবরীল (আঃ) মারফৎ মারয়্যাম ('আলাইহাস্ সালাম)এর নিকট পৌঁছে দেন। (তাফসীরে ইবনে কাসীর)
[৩] খ্রিষ্টানরা বিভিন্ন ফির্কায় বিভক্ত ছিল। কোন ফির্কা ঈসা (আঃ)-কে স্বয়ং আল্লাহ বলে বিশ্বাস করে, কোন ফির্কা তাঁকে আল্লাহর অংশীদার মনে করে, আবার কোন ফির্কা তাঁকে আল্লাহর পুত্র মনে করে। তারপর যারা আল্লাহতে বিশ্বাসী, তারা ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসী। তাদের মতে পিতা, পুত্র ও মারয়্যাম তিনজনই ঈশ্বর। তারা ঈসা (আঃ)-কে তিনের এক ঈশ্বর মনে করে থাকে। সুতরাং মহান আল্লাহ বলেন, "তোমরা 'আল্লাহ তিনজন' বলা হতে বিরত হও। কারণ আল্লাহ হচ্ছেন একক, অদ্বিতীয়, (যাঁর কোন শরীক নেই)।"
Tafsir Abu Bakr Zakaria
হে কিতাবীরা! স্বীয় দ্বীনের মধ্যে তোমরা বাড়াবাড়ি করো না [১] এবং আল্লাহর উপর সত্য ব্যতীত কিছু বলো না। মারইয়াম-তনয় ঈসা মসীহ কেবল আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর বাণী [২], যা তিনি মারইয়ামের কাছে পাঠিয়েছিলেন ও তাঁর পক্ষ থেকে রূহ। কাজেই তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলদের উপর ঈমান আন এবং বলো না, ‘তিন [৩] !’ নিবৃত্ত হও, এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর হবে। আল্লাহই তো এক ইলাহ; তাঁর সন্তান হবে - - -তিনি এটা থেকে পবিত্র-মহান। আসমানসমূহে যা কিছু আছে ও যমীনে যা কিছু আছে সব আল্লাহরই; আর কর্মবিধায়করূপে আল্লাহই যথেষ্ট [৪]।
[১] (غُلُوّ) শব্দের অর্থ সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া। অর্থাৎ দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করার অর্থ তার ন্যায়সঙ্গত সীমারেখা অতিক্রম করা । আহলে কিতাব অর্থাৎ ইয়াহুদী-নাসারা উভয় জাতিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, দ্বীনের ব্যাপারে কোনরূপ বাড়াবাড়ি করো না। কারণ এ বাড়াবাড়ি রোগে উভয় জাতিই আক্রান্ত হয়েছে। নাসারারা ঈসা ‘আলাইহিস সালাম-কে ভক্তি-শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছে। তাকে স্বয়ং আল্লাহ, আল্লাহর পুত্র অথবা তিনের এক আল্লাহ বানিয়ে দিয়েছে। অপরদিকে ইয়াহুদীরা তাকে অমান্য ও প্রত্যাখ্যান করার দিক দিয়ে বাড়াবাড়ি পথ অবলম্বন করেছে। তারা ঈসা ‘আলাইহিস সালাম-কে আল্লাহর নবী হিসেবে স্বীকার করেনি। বরং তাঁর মাতা মারইয়াম ‘আলাইহিস সালাম-এর উপর মারাত্মক অপবাদ আরোপ করেছে এবং তার নিন্দাবাদ করেছে। দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবড়ি ও সীমালংঘনের কারণে ইয়াহুদী ও নাসারাদের গোমরাহী ও ধ্বংস হওয়ার শোচনীয় পরিণতি বার বার প্রত্যক্ষ হয়েছে। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রিয় উম্মতকে এ ব্যাপারে সংযত থাকার জন্য সতর্ক করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন ‘তোমরা আমার প্রশংসা করতে গিয়ে এমন অতিরঞ্জিত করো না, যেমন নাসারারা ঈসা ইবন মারইয়াম ‘আলাইহিমুস্ সালাম-এর ব্যাপারে করেছে। স্মরণ রাখবে যে, আমি আল্লাহর বান্দা। অতএব, আমাকে আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল বলবে’। [বুখারীঃ ৩৪৪৫]
অর্থাৎ আল্লাহর বান্দা ও মানুষ হিসেবে আমিও অন্য লোকদের সমপর্যায়ের। তবে আমার সবচেয়ে বড় মর্যাদা এই যে, আমি আল্লাহর রাসূল। এর চেয়ে অগ্রসর করে আমাকে আল্লাহ্ তা’আলার কোন বিশেষণে বিশেষিত করা বাড়াবাড়ি বৈ নয়। তোমরা ইয়াহুদী-নাসারাদের মতো বাড়াবাড়ি করো না। হাদীসে এসেছে যে, হজের সময় ‘রমীয়ে জামারাহ’ অর্থাৎ কংকর নিক্ষেপের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা-কে কংকর আনতে আদেশ করলেন। তিনি মাঝারি আকারের পাথরকুচি নিয়ে এলে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত পছন্দ করলেন এবং বললেন, ‘এ ধরণের মাঝারী আকারের কংকর নিক্ষেপ করাই পছন্দনীয়’। বাক্যটি তিনি দু’বার বললেন। তারপর বললেন, ‘তোমরা দ্বীনের মধ্যে বাড়াবাড়ি থেকে দূরে থেকো। কেননা, তোমাদের পূর্ববতী উম্মতসমূহ তাদের দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করার কারণেই ধ্বংস হয়েছে’। [ইবন মাজাহ; ৩০২৯]
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন একটি কাজ করলেন যাতে ‘রুখসত’ বা ছাড় ছিল। কিন্তু কিছু লোক সেটা করতে অপছন্দ করল। সেটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে পৌঁছলে তিনি আল্লাহর হামদ ও প্রশংসার পর বললেন, কিছু লোকের এ কি অবস্থা হয়েছে যে, তারা আমি যা করছি তা করা থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়? আল্লাহর শপথ, আল্লাহর ব্যাপারে আমি তাদের থেকে সবচেয়ে বেশী জানি এবং তাদের থেকেও বেশী আল্লাহর ভয় করি। [বুখারী; ৭৩০১]
[২] এখানে ‘কালেমাতুহু’ শব্দে বাতলে দেয়া হয়েছে যে, ঈসা ‘আলাইহিস সালাম আল্লাহর কালেমা। মুফাসসিরগণ এর বিভিন্ন অর্থ বর্ণনা করেছেন-
(এক) ‘কালেমাতুল্লাহ’ অর্থ আল্লাহর সুসংবাদ। এর দ্বারা ঈসা ‘আলাইহিস সালাম-এর ব্যক্তি-সত্তাকে বোঝানো হয়েছে। ইতোপূর্বে আল্লাহ তা’আলা ফিরিশতার মাধ্যমে মারইয়াম ‘আলাইহিস সালামকে ঈসা ‘আলাইহিস সালাম সম্পর্কে যে সুসংবাদ দান করেছিলেন সেখানে ‘কালেমা’ শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে। বলা হয়েছে,
(اِذْ قَالَتِ الْمَلٰۗىِٕكَةُ يٰمَرْيَمُ اِنَّ اللّٰهَ يُبَشِّرُكِ بِكَلِمَةٍ)
“যখন ফিরিশতারা বললো, হে মারইয়াম! নিশ্চয় আল্লাহ তোমাকে সুসংবাদ দিচ্ছেন এক ‘কালেমা’র”। [সূরা আলে-ইমরানঃ ৪৫] (দুই) কারো মতে এখানে ‘কালেমা’ অর্থ নিদর্শন। যেমন অন্য এক আয়াতে শব্দটি নিদর্শন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যথা; (وَصَدَّقَتْ بِكَلِمٰتِ رَبِّهَا) [সূরা আত-তাহরীম; ১২] তাই আল্লাহ্ তা’আলা কর্তৃক মারইয়ামের প্রতি কালেমা পাঠাবার অর্থ হচ্ছে এই যে, আল্লাহ তা’আলা মারইয়াম আলাইহাস সালামের গর্ভাধারকে কোন পুরুষের শুক্ৰকীটের সহায়তা ছাড়াই গর্ভধারণের হুকুম দিলেন। সে হিসেবে ঈসা ‘আলাইহিস সালাম শুধু আল্লাহর কালেমা বা নির্দেশে চিরাচরিত প্রথার বিপরীতে পিতার মাধ্যম ছাড়াই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। (তিন) কাতাদা বলেন, কালেমা দ্বারা (كُنْ) বা ‘হও’ শব্দ বোঝানো হয়েছে। [তাবারী] ঈসা ‘আলাইহিস সালামকে ‘কালেমাতুল্লাহ’ বলার কারণ হচ্ছে এই যে, ঈসা ‘আলাইহিস সালামের জন্মের ব্যাপারটি জাগতিক কোন মাধ্যম বাদেই আল্লাহর কালেমা দ্বারা সংঘটিত হয়েছে। এখানে তাকে ‘আল্লাহর কালাম’ বলে বিশেষভাবে উল্লেখ করে সম্মানিত করাই উদ্দেশ্য। নতুবা সবকিছুই আল্লাহর কালেমার মাধ্যমেই হয়। তাঁর কালেমা ব্যতীত কিছুই হয় না। আল্লাহ ঈসা ‘আলাইহিস সালামকে তাঁর নিদর্শন ও আশ্চৰ্যতম সৃষ্টি হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। তিনি জিবরাইল ‘আলাইহিস সালামকে মারইয়ামের নিকট পাঠালেন। জিবরাইল ‘আলাইহিস সালাম তার জামার ফাঁকে ফু দিলেন। এ পবিত্র ফেরেশতার পবিত্র ফুঁ মারইয়ামের গর্ভে প্রবেশ করলে আল্লাহ তা’আলা সে ফুঁকটিকে পবিত্র রুহ হিসেবে পরিণত করলেন। আর এ জন্যই তাঁকে সম্মানিত করে ‘রুহুল্লাহ’ বলা হয়ে থাকে। [তাফসীরে সা’দী]
[৩] কুরআন নাযিলের সমসাময়িক কালে খৃষ্টানরা যেসব উপদলে বিভক্ত ছিল, তন্মধ্যে ত্রিত্ববাদ সম্পর্কে তাদের ধর্মবিশ্বাস তিনটি ভিন্ন ভিন্ন মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। এক দল মনে করতো- মসীহই আল্লাহ। স্বয়ং আল্লাহই মসীহরূপে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন। দ্বিতীয় দল বলতো -মসীহ পুত্র। তৃতীয় দলের বিশ্বাস ছিল -তিন সদস্যের সমন্বয়ে আল্লাহর একক পরিবার। এ দলটি আবার দু’টি উপদলে বিভক্ত ছিল। এক দলের মতে পিতা, পুত্র ও মারইয়াম এ তিনের সমন্বয়ে এক আল্লাহ। অন্য একদলের মতে মারইয়াম ‘আলাইহিস সালাম-এর পরিবর্তে ‘রূহুল কুদুস’ বা পবিত্র আত্মা জিবরাঈল ‘আলাইহিস সালাম ছিলেন তিন আল্লাহর একজন। মোটকথা, খৃষ্টানরা ঈসা ‘আলাইহিস সালাম-কে তিনের এক আল্লাহ মনে করতো। তাদের ভ্রান্তি অপনোদনের জন্য কুরআনুল কারীমে প্রত্যেকটি উপদলকে ভিন্ন ভিন্নভাবে সম্বোধন করা হয়েছে এবং সম্মিলিতভাবেও সম্বোধন করা হয়েছে। তাদের সামনে স্পষ্ট ও জোরালোভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে, সত্য একটিই। আর তা হলো ঈসা মসীহ ‘আলাইহিস সালাম তার মাতা মারইয়াম ‘আলাইহিস সালাম -এর গর্ভে জন্মগ্রহণকারী একজন মানুষ ও আল্লাহ্ তা’আলার সত্য রাসূল। এর অতিরিক্ত তাঁর সম্পর্কে যা কিছু বলা বা ধারণা করা হয়, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও বাতিল। তাঁর প্রতি ইয়াহুদীদের মত অবজ্ঞা বা ঈর্ষা পোষণ করা অথবা খৃষ্টানদের মত অতিভক্তি প্রদর্শন করা সমভাবে নিন্দনীয় ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কুরআনুল কারীমের অসংখ্য আয়াতে একদিকে ইয়াহুদী-খৃষ্টানদের পথভ্রষ্টতা দৃঢ়ভাবে প্রকাশ করা হয়েছে, অপরদিকে আল্লাহ্ তা’আলার দরবারে ঈসা ‘আলাইহিস সালাম-এর উচ্চ মর্যাদা ও বিশেষ সম্মানের অধিকারী হওয়ার কথাও জোরালোভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে। ফলে অবজ্ঞা ও অতিভক্তি দু’টি পরস্পর বিরোধী ভ্রান্ত মতবাদের মধ্যবর্তী সত্য ও ন্যায়ের সঠিক পথ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
[৪] অর্থাৎ আকাশ ও যমীনের উপর হতে নীচে পর্যন্ত যাকিছু আছে সবই আল্লাহ তা'আলার সৃষ্টি ও তাঁর বান্দা। অতএব, তাঁর কোন অংশীদার বা পুত্র-পরিজন হতে পারে না। আল্লাহ তা’আলা একাই সর্বকার্য সম্পাদনকারী এবং সকলের কার্য সম্পাদনের জন্য তিনি একাই যথেষ্ট; অন্য কারো সাহায্য-সহযোগীতার প্রয়োজন নেই। তিনি একক, তাঁর কোন অংশীদার বা পুত্র-পরিজন থাকতে পারে না। সারকথা, কোন সৃষ্ট ব্যক্তিরই স্রষ্টার অংশীদার হওয়ার যোগ্যতা নেই। আল্লাহ তা’আলার পবিত্র সত্তার জন্য এর অবকাশও নেই, প্রয়োজনও নেই। অতএব, একমাত্র বিবেকবর্জিত, ঈমান হতে বঞ্চিত ব্যক্তি ছাড়া আল্লাহ্ তা’আলার সৃষ্ট কোন জীবকে তাঁর অংশীদার বা পুত্র বলা অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়।
Tafsir Bayaan Foundation
হে কিতাবীগণ, তোমরা তোমাদের দীনের মধ্যে বাড়াবাড়ি করো না এবং আল্লাহর উপর সত্য ছাড়া অন্য কিছু বলো না। মারইয়ামের পুত্র মাসীহ ঈসা কেবলমাত্র আল্লাহর রাসূল ও তাঁর কালিমা, যা তিনি প্রেরণ করেছিলেন মারইয়ামের প্রতি এবং তাঁর পক্ষ থেকে রূহ। সুতরাং তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের প্রতি ঈমান আন এবং বলো না, 'তিন'। তোমরা বিরত হও, তা তোমাদের জন্য উত্তম। আল্লাহই কেবল এক ইলাহ, তিনি পবিত্র মহান এ থেকে যে, তাঁর কোন সন্তান হবে। আসমানসূহে যা রয়েছে এবং যা রয়েছে যমীনে, তা আল্লাহরই। আর কর্মবিধায়ক হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।
Muhiuddin Khan
হে আহলে-কিতাবগণ! তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না এবং আল্লাহর শানে নিতান্ত সঙ্গত বিষয় ছাড়া কোন কথা বলো না। নিঃসন্দেহে মরিয়ম পুত্র মসীহ ঈসা আল্লাহর রসূল এবং তাঁর বাণী যা তিনি প্রেরণ করেছেন মরিয়মের নিকট এবং রূহ-তাঁরই কাছ থেকে আগত। অতএব, তোমরা আল্লাহকে এবং তার রসূলগণকে মান্য কর। আর একথা বলো না যে, আল্লাহ তিনের এক, একথা পরিহার কর; তোমাদের মঙ্গল হবে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ একক উপাস্য। সন্তান-সন্ততি হওয়াটা তাঁর যোগ্য বিষয় নয়। যা কিছু আসমান সমূহ ও যমীনে রয়েছে সবই তার। আর কর্মবিধানে আল্লাহই যথেষ্ট।
Zohurul Hoque
মসীহ্ কখনো কুণ্ঠাবোধ করেন না আল্লাহ্র বান্দা বনতে, আর সান্নিধ্যে থাকা ফিরিশ্তারাও করে না। আর যে কেউ তাঁর সেবায় কুণ্ঠাবোধ করে ও অহংকার করে, তিনি তাহলে তাঁর দিকে তাদের একত্রিত করবেন একজোটে।