Skip to content

কুরআন মজীদ সূরা আন-নূর আয়াত ১১

Qur'an Surah An-Nur Verse 11

আন-নূর [২৪]: ১১ ~ শব্দ অনুবাদ দ্বারা শব্দ

اِنَّ الَّذِيْنَ جَاۤءُوْ بِالْاِفْكِ عُصْبَةٌ مِّنْكُمْۗ لَا تَحْسَبُوْهُ شَرًّا لَّكُمْۗ بَلْ هُوَ خَيْرٌ لَّكُمْۗ لِكُلِّ امْرِئٍ مِّنْهُمْ مَّا اكْتَسَبَ مِنَ الْاِثْمِۚ وَالَّذِيْ تَوَلّٰى كِبْرَهٗ مِنْهُمْ لَهٗ عَذَابٌ عَظِيْمٌ (النور : ٢٤)

inna
إِنَّ
Indeed
নিশ্চয়ই
alladhīna
ٱلَّذِينَ
those who
যারা
jāū
جَآءُو
brought
তারা এসেছে
bil-if'ki
بِٱلْإِفْكِ
the lie
নিয়ে অপবাদ রচনা
ʿuṣ'batun
عُصْبَةٌ
(are) a group
(তারা) একটি দল
minkum
مِّنكُمْۚ
among you
তোমাদের মধ্যকার
لَا
(Do) not
না
taḥsabūhu
تَحْسَبُوهُ
think it
তা তোমরা মনে করো
sharran
شَرًّا
bad
খারাপ
lakum
لَّكُمۖ
for you
জন্যে তোমাদের
bal
بَلْ
nay
বরং
huwa
هُوَ
it
তা
khayrun
خَيْرٌ
(is) good
ভালো
lakum
لَّكُمْۚ
for you
জন্যে তোমাদের
likulli
لِكُلِّ
For every
জন্যে প্রত্যেক
im'ri-in
ٱمْرِئٍ
person
ব্যক্তির (রয়েছে)
min'hum
مِّنْهُم
among them
তাদের মধ্য হ'তে
مَّا
(is) what
যতটা
ik'tasaba
ٱكْتَسَبَ
he earned
সে অর্জন করেছে
mina
مِنَ
of
হ'তে
l-ith'mi
ٱلْإِثْمِۚ
the sin
পাপ
wa-alladhī
وَٱلَّذِى
and the one who
আর যে
tawallā
تَوَلَّىٰ
took upon himself a greater share of it
দায়িত্ব নিয়েছে (নিজের উপর)
kib'rahu
كِبْرَهُۥ
took upon himself a greater share of it
তার বড় (অংশ)
min'hum
مِنْهُمْ
among them
মধ্য হ'তে তাদের
lahu
لَهُۥ
for him
জন্যে তার (রয়েছে)
ʿadhābun
عَذَابٌ
(is) a punishment
শাস্তি
ʿaẓīmun
عَظِيمٌ
great
কঠিন

Transliteration:

Innal lazeena jaaa'oo bilifki 'usbatum minkum; laa tahsaboohu sharral lakum bal huwa khairul lakum; likul limri'im minhum mak tasaba minal-ism; wallazee tawallaa kibrahoo minhum lahoo 'azaabun 'azeem (QS. an-Nūr:11)

English Sahih International:

Indeed, those who came with falsehood are a group among you. Do not think it bad for you; rather, it is good for you. For every person among them is what [punishment] he has earned from the sin, and he who took upon himself the greater portion thereof – for him is a great punishment [i.e., Hellfire]. (QS. An-Nur, Ayah ১১)

তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):

যারা এ অপবাদ উত্থাপন করেছে তারা তোমাদেরই একটি দল, এটাকে তোমাদের জন্য ক্ষতিকর মনে কর না, বরং তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। তাদের প্রত্যেকের জন্য আছে প্রতিফল যতটুকু পাপ সে করেছে। আর এ ব্যাপারে যে নেতৃত্ব দিয়েছে তার জন্য আছে মহা শাস্তি। (আন-নূর, আয়াত ১১)

Tafsir Ahsanul Bayaan

যারা মিথ্যা অপবাদ রটনা করেছে[১] তারা তো তোমাদেরই একটি দল;[২] এই অপবাদকে তোমরা তোমাদের জন্য অনিষ্টকর মনে করো না; বরং এ তো তোমাদের জন্য কল্যাণকর[৩] ওদের প্রত্যেকের জন্য নিজ নিজ কৃত পাপকর্মের প্রতিফল আছে আর ওদের মধ্যে যে এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছে তার জন্য আছে মহাশাস্তি।[৪]

[১] إِفْك বলতে সেই মিথ্যা অপবাদ রটনার ঘটনাকে বুঝানো হয়েছে, যে ঘটনায় মুনাফিকরা মা আয়েশা (রাঃ) -এর চরিত্রে ও সতীত্বে কলঙ্ক ও কালিমা লেপন করতে চেয়েছিল। কিন্তু মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে মা আয়েশার পবিত্রতার স্বপক্ষে আয়াত অবতীর্ণ করে তাঁর সতীত্বকে অধিক উজ্জ্বল করে দিয়েছেন। সংক্ষেপে সেই ঘটনা হল এইরূপঃ পর্দার আদেশ অবতীর্ণ হওয়ার পর বানু মুস্তালিক (মুরাইসী') যুদ্ধ হতে ফিরে আসার পথে আল্লাহর নবী (সাঃ) ও সাহাবা (রাঃ) গণ মদীনার নিকটবর্তী এক স্থানে রাত্রে বিশ্রাম নিলেন। প্রত্যূষে আয়েশা (রাঃ) নিজের প্রয়োজনে একটু দূরে গেলেন। ফিরার পথে দেখলেন তাঁর গলার হার হারিয়ে গেছে। খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে ঠিকানায় ফিরতে দেরী হল। এদিকে মহানবী (সাঃ)-এর আদেশে তাঁরা সেখান হতে কুচ করলেন। মা আয়েশার হাওদাজ (উটের পিঠে রাখা পালকির মত মেয়েদের বসার ঘর) লোকেরা উটের উপর রেখে নিয়ে সেখান হতে বিদায় নিলেন। আয়েশা (রাঃ) পাতলা গড়নের হাল্কা মহিলা ছিলেন। তাঁরা ভাবলেন, তিনি ভিতরেই আছেন। যখন তিনি ফিরে এলেন, তখন দেখলেন যে, কাফেলা রওনা দিয়েছে। তিনি সেখানেই শুয়ে গেলেন এই আশায় যে, তাঁরা আমার অনুপস্থিতির কথা টের পেতেই আমার খোঁজে ফিরে আসবেন। কিছুক্ষণ পর স্বাফওয়ান বিন মুআত্তাল সুলামী (রাঃ) সেখানে এলেন। তাঁর দায়িত্ব ছিল, কাফেলা কোন জিনিস-পত্র ফেলে গেলে পিছন থেকে তা তুলে নেওয়া। তিনি মা আয়েশা (রাঃ) -কে পর্দার আগে দেখেছিলেন। তিনি দেখার সঙ্গে সঙ্গে 'ইন্না লিল্লাহি অইন্না ইলাইহি রাজিঊন' পড়লেন এবং তিনি বুঝে নিলেন যে, কাফেলা ভুল করে বা অজানা অবস্থায় তাঁকে এখানে ফেলে কুচ করে গেছে। অতঃপর তিনি নিজের উট বসিয়ে তাঁকে চড়তে ইঙ্গিত করলেন ও নিজে উটের লাগাম ধরে পায়ে হেঁটে কাফেলার সাথে মিলিত হলেন। মুনাফিকরা যখন মা আয়েশা (রাঃ) -কে এ অবস্থায় একাকিনী স্বাফওয়ান (রাঃ)-এর সাথে আসতে দেখল, তখন তারা সুযোগ বুঝে তার সদ্ব্যবহার করতে চাইল। মুনাফিকদের নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাই বলেই ফেলল যে, একাকিনী ও সবার থেকে আলাদা থাকার নিশ্চয় কোন কারণ আছে! আর এভাবে তারা মা আয়েশাকে স্বাফওয়ানের সঙ্গে জড়িয়ে কলঙ্ক রচনা করল। অথচ তাঁরা দু'জনে এসব থেকে একেবারে উদাসীন ছিলেন। কিছু নিষ্ঠাবান মুসলমানও মুনাফিকদের ঐ রটনার ফাঁদে ফেঁসে গেলেন। যেমন, হাসসান বিন সাবেত, মিসত্বাহ বিন উসাসাহ, হামনাহ বিনতে জাহাশ। এই ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা সহীহ হাদীসসমূহে রয়েছে। নবী (সাঃ) একমাস (মতান্তরে ৫০/৫৫ দিন) পর্যন্ত যতক্ষণ না আল্লাহর পক্ষ থেকে আয়েশা (রাঃ) -র সতীত্বের আয়াত অবতীর্ণ হল, ততক্ষণ অত্যন্ত ব্যাকুল ছিলেন এবং আয়েশা (রাঃ) ও কিছু না জানার ফলে নিজের জায়গায় অস্থির অবস্থায় দিন-রাত্রি কাটিয়েছেন। এই আয়াতগুলোতে মহান আল্লাহ সেই ঘটনার সংক্ষিপ্ত ও ব্যাপক বর্ণনা দিয়েছেন। إِفْك শব্দের মূল অর্থ হল কোন জিনিসকে উল্টে দেওয়া। এই ঘটনায় যেহেতু মুনাফিকরা আসল ব্যাপারকে উল্টে দিয়েছিল, সেহেতু এই ঘটনা ইতিহাসে 'ইফকে আয়েশা' নামে প্রসিদ্ধ; মা আয়েশা (রাঃ) যিনি ছিলেন সতী-সাধ্বী, প্রশংসার পাত্রী, উচ্চবংশীয়া ও মহান চরিত্রের অধিকারিণী, তাঁর সবকিছু তারা উল্টে দিয়ে তাঁর সতীত্বে ও চরিত্রে অপবাদ ও কলঙ্কের কালিমা লেপন করে দিয়েছিল!




[২] একটি দল ও জামাআতকে عُصبَة বলা হয়। কারণ তারা এক অপরের সাথে মিলে শক্তি বৃদ্ধি ও পক্ষপাতিত্ব করে থাকে।




[৩] কারণ, এতে দুঃখ-কষ্টের ফলে তোমাদের অতিশয় সওয়াব লাভ হবে, অন্য দিকে আসমান হতে আয়েশা (রাঃ) -র পবিত্রতা অবতীর্ণ হওয়ায় তাঁর মাহাত্ম্য ও বংশ-গৌরব ও মর্যাদা আরো স্পষ্ট হল। এ ছাড়া ঈমানদারদের জন্য এতে রয়েছে অনেক শিক্ষণীয় বিষয়।




[৪]এ থেকে আব্দুল্লাহ বিন উবাই মুনাফিককে বুঝানো হয়েছে; যে এই অপবাদের মূল হর্তাকর্তা ছিল।

Tafsir Abu Bakr Zakaria

নিশ্চয় যারা এ অপবাদ [১] রচনা করেছে, তারা তো তোমাদেরই একটি দল [২]; এটাকে তোমরা তোমাদের জন্য অনিষ্টকর মনে করো না; বরং এটাতো তোমাদের জন্য কল্যাণকর; তাদের প্রত্যেকের জন্য আছে তাদের পাপকাজের ফল [৩] এবং তাদের মধ্যে যে এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছে, তার জন্য আছে মহা শাস্তি [৪]।

[১] পূর্বেই বর্ণিত হয়েছে যে, সূরা আন-নূরের অধিকাংশ আয়াত চারিত্রিক নিষ্কলুষতা ও পবিত্ৰতা সংরক্ষণের জন্য প্রবর্তিত বিধানাবলীর সাথে সম্পর্কযুক্ত। এর বিপরীতে চারিত্রিক নিষ্কলুষতা ও পবিত্রতার উপর অবৈধ হস্তক্ষেপ ও এর বিরুদ্ধাচরণের জাগতিক শাস্তি ও আখেরাতের মহা বিপদের কথা আলোচনা করা হয়েছে। তাই পরম্পরায় প্রথমে ব্যভিচারের শাস্তি, তারপর অপবাদের শাস্তি ও পরে লি‘আনের কথা বর্ণিত হয়েছে। অপবাদের শাস্তি সম্পর্কে চার জন সাক্ষীর অবর্তমানে কোন পবিত্ৰা নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করাকে মহাপাপ সাব্যস্ত করা হয়েছে। এরূপ অপবাদ আরোপকারীর শাস্তি আশিটি বেত্ৰাঘাত প্রবর্তন করা হয়েছে। এ বিষয়টি সাধারণ মুসলিম পবিত্ৰা নারীদের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। ষষ্ট হিজরীতে কতিপয় মুনাফেক উন্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার প্রতি এমনি ধরণের অপবাদ আরোপ করেছিল এবং তাদের অনুসরণ করে কয়েকজন মুসলিমও এ আলোচনায় জড়িত হয়ে পড়েছিলেন। ব্যাপারটি সাধারণ মুসলিম সচ্চরিত্রা নারীদের পক্ষে অত্যাধিক গুরুতর ছিল। তাই কুরআনুল কারীমে আল্লাহ্‌ তা‘আলা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার পবিত্ৰতা বর্ণনা করে এ স্থলে উপরোক্ত দশটি আয়াত নাযিল করেছেন। [ইবন কাসীর] এসব আয়াতে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার পবিত্ৰতা ঘোষণা করতঃ তার ব্যাপারে যারা কুৎসা রটনা ও অপপ্রচারে অংশগ্রহণ করেছিল, তাদের সবাইকে হুশিয়ার করা হয়েছে এবং দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের বিপদ বর্ণনা করা হয়েছে। এই অপবাদ রটনার ঘটনাটি কুরআন ও হাদীসে ‘ইফকের ঘটনা’ নামে খ্যাত। ইফক শব্দের অর্থ জঘন্য মিথ্যা অপবাদ। [বাগভী] এসব আয়াতের তাফসীর বুঝার জন্য অপবাদের কাহিনীটি জেনে নেয়া অত্যন্ত জরুরী। তাই প্ৰথমে সংক্ষেপে কাহিনীটি বর্ণনা করা হচ্ছে।

বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে এই ঘটনাটি অসাধারণ দীর্ঘ ও বিস্তারিত আকারে উল্লেখ করা হয়েছে। এর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা এই যে, ষষ্ঠ হিজরীতে যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনী মুস্তালিক নামান্তরে মুরাইসী যুদ্ধে গমন করেন, তখন স্ত্রীদের মধ্য থেকে আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা সাথে ছিলেন। ইতিপূর্বে নারীদের পর্দার বিধান নাযিল হয়েছিল। তাই আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার উটের পিঠে পর্দাবিশিষ্ট আসনের ব্যবস্থা করা হয়। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা প্রথমে পর্দাবিশিষ্ট আসনে সওয়ার হয়ে যেতেন। এরপর লোকেরা আসনটিকে উটের পিঠে বসিয়ে দিত। এটাই ছিল নিত্যকার নিয়ম। যুদ্ধ সমাপ্তির পর মদীনায় ফেরার পথে একদিন একটি ঘটনা ঘটল। এক মনযিলে কাফেলা অবস্থান করার পর শেষ রাতে প্রস্থানের কিছু পূর্বে ঘোষণা করা হল যে, কাফেলা কিছুক্ষণের মধ্যেই এখান থেকে রওয়ানা হয়ে যাবে। তাই প্ৰত্যেকেই যেন নিজ নিজ প্রয়োজন সেরে প্রস্তুত হয়। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা প্রয়োজন সারতে জঙ্গলের দিকে চলে গেলেন। সেখানে ঘটনাক্রমে তার গলার হার ছিঁড়ে কোথাও হারিয়ে গেল। তিনি সেখানে হারটি খুঁজতে লাগলেন। এতে বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হয়ে গেল। অতঃপর স্বস্থানে ফিরে এসে দেখলেন যে, কাফেলা রওয়ানা হয়ে গেছে। রওয়ানা হওয়ার সময় আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার আসনটি যথারীতি উটের পিঠে সওয়ার করিয়ে দেয়া হয়েছে এবং বাহকরা মনে করেছে যে, তিনি ভেতরেই আছেন। এমনকি উঠানোর সময়ও সন্দেহ হল না। কারণ, তিনি তখন অল্পবয়স্কা ক্ষীণাঙ্গিণী ছিলেন। ফলে আসনটি যে শূণ্য এরূপ ধারণাও কারো মনে উদয় হল না। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা ফিরে এসে যখন কাফেলাকে পেলেন না, তখন অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা ও স্থিরচিত্ততার পরিচয় দিলেন এবং কাফেলার পশ্চাতে দৌড়াদৌড়ি করা কিংবা এদিক-ওদিক খুঁজে দেখার পরিবর্তে স্বস্থানে চাদর গায়ে জড়িয়ে বসে রইলেন। তিনি মনে করলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সঙ্গীগণ যখন জানতে পারবেন যে, আমি আসনে অনুপস্থিত তখন আমার খোঁজে তারা এখানে আসবেন। কাজেই আমি এদিক-সেদিক চলে গেলে তাদের জন্য আমাকে খুঁজে বের করা মুশকিল হয়ে যাবে। সময় ছিল শেষ রাত, তাই তিনি কিছুক্ষণের মধ্যেই নিদ্রার কোলে ঢলে পড়লেন।

অপরদিকে সফওয়ান ইবনে মুয়াত্তাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কাজের জন্য নিযুক্ত করেছিলেন যে, তিনি কাফেলার পশ্চাতে সফর করবেন এবং কাফেলা রওয়ানা হয়ে যাওয়ার পর কোন কিছু পড়ে থাকলে তা কুড়িয়ে নেবেন। তিনি সকাল বেলায় এখানে পৌঁছলেন। তখন পর্যন্ত প্রভাত-রশ্মি ততটুকু উজ্জ্বল ছিল না। তিনি শুধু একজন মানুষকে নিদ্রামগ্ন দেখতে পেলেন। কাছে এসে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাকে চিনে ফেললেন। কারণ, পর্দা সংক্রান্ত আয়াত নাযিল হওয়ার পূর্বে তিনি তাকে দেখেছিলেন। চেনার পর অত্যন্ত বিচলিত কণ্ঠে তার মুখ থেকে ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্নাইলাইহি রাজি‘উন’ উচ্চারিত হয়ে গেল। এই বাক্য আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার কানে পৌছার সাথে সাথে তিনি জাগ্রত হয়ে গেলেন এবং মুখমণ্ডল ঢেকে ফেললেন। সফওয়ান নিজের উট কাছে এনে বসিয়ে দিলেন। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা তাতে সওয়ার হয়ে গেলেন এবং সফওয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহু নিজে উটের নাকের রশি ধরে পায়ে হেঁটে চলতে লাগলেন। অবশেষে তিনি কাফেলার সাথে মিলিত হয়ে গেলেন।

আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ছিল দুশ্চরিত্র, মুনাফেক ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শত্রু। সে একটা সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে গেল। এই হতভাগা আবোল-তাবোল বকতে শুরু করল। কিছুসংখ্যক সরল-প্রাণ মুসলিমও কানকথায় সাড়া দিয়ে এ আলোচনায় মেতে উঠল। পুরুষদের মধ্যে হাসসান ইবনে সাবিত, মিস্তাহ ইবনে আসাল এবং নারীদের মধ্যে হামনাহ বিনতে জাহাশ ছিল এ শ্রেণীভুক্ত।

যখন এই মুনাফেক-রটিত অপবাদের চর্চা হতে লাগল, তখন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এতে খুবই মর্মাহত হলেন। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার তো দুঃখের সীমাই ছিল না। সাধারণ মুসলিমগণও তীব্রভাবে বেদানাহত হলেন। একমাস পর্যন্ত এই আলোচনা চলতে লাগল। অবশেষে আল্লাহ্‌ তা‘আলা উন্মুল মু’মিনীন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার পবিত্রতা বর্ণনা এবং অপবাদ রটনাকারী ও এতে অংশগ্রহণকারীদের নিন্দা করে উপরোক্ত আয়াতসমূহ নাযিল করলেন। অপবাদের হদ-এ বর্ণিত কুরআনী-বিধান অনুযায়ী অপবাদ আরোপকারীদের কাছ থেকে সাক্ষ্য তলব করা হল। তারা এই ভিত্তিহীন খবরের সাক্ষ্য কোথা থেকে আনবে? ফলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম শরীয়তের নিয়মানুযায়ী তাদের প্রতি অপবাদের হদ প্রয়োগ করলেন। প্রত্যেককে আশিটি বেত্ৰাঘাত করা হল। [আবু দাউদের বর্ণনায়, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন জন মুসলিম মিসতাহ, হামানাহ ও হাসসানের প্রতি হদ প্রয়োগ করেন। [আবু দাউদঃ ৪৪৭৪] অতঃপর মুসলিমরা তাওবাহ করে নেয় এবং মুনাফেকরা তাদের অবস্থানে কায়েম থাকে। তবে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম শাস্তি দিয়েছেন প্রমাণিত হয়নি। যদিও তাবরানী কয়েকজন সাহাবী থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে শাস্তি দিয়েছেন। [দেখুন- মু‘জামুল কাবীরঃ ২৩/১৪৬(২১৪), ২৩/১৩৭(১৮১), ২৩/১২৫(১৬৪), ২৩/১২৪(১৬৩)]

[২] عُصْبَةٌ শব্দের অর্থ দশ থেকে চল্লিশ জন পর্যন্ত লোকের দল। এর কমবেশীর জন্যও এই শব্দ ব্যবহৃত হয়। [দেখুন-ইবন কাসীর, কুরতুবী, ফাতহুল কাদীর]

[৩] অর্থাৎ যারা এই অপবাদে যতটুকু অংশ নিয়েছে, তাদের জন্য সে পরিমাণ গোনাহ লেখা হয়েছে এবং সে অনুপাতেই তাদের শাস্তি হবে। [বাগভী]

[৪] উদ্দেশ্য এই যে, যে ব্যাক্তি অপবাদে বড় ভূমিকা নিয়েছে অর্থাৎ একে রচনা করে চালু করেছে, তার জন্য গুরুতর আযাব রয়েছে। বলাবাহুল্য, এ ব্যক্তি হচ্ছে মুনাফেক আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই। [মুয়াসসার]

Tafsir Bayaan Foundation

নিশ্চয়ই যারা এ অপবাদ* রটনা করেছে, তারা তোমাদেরই একটি দল। এটাকে তোমরা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর মনে করো না, বরং এটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। তাদের থেকে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য রয়েছে, যতটুকু পাপ সে অর্জন করেছে। আর তাদের থেকে যে ব্যক্তি এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে, তার জন্য রয়েছে মহাআযাব।

* এটি উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা) এর প্রতি মিথ্যা অপবাদের ঘটনা। ৬ষ্ঠ হিজরীতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনূ মুস্তালিক যুদ্ধ থেকে ফিরার পথে একস্থানে রাত্রিযাপনের জন্য অবস্থান করেন। রাতের শেষ ভাগে আয়েশা (রা) প্রাকৃতিক প্রয়োজনে একটু দূরে যান। কিন্তু পথে তিনি তাঁর গলার হারটি হারিয়ে ফেলেন। তিনি তাঁর হার খুঁজতে থাকেন। এদিকে কাফেলা রওনা হয়ে যায়। তিনি হাওদার ভিতরেই আছেন মনে করে কেউ তাঁর খোঁজ করেনি কারণ তাঁর শারীরিক গড়ন ছিল হালকা। হার খুঁজে পেয়ে তিনি এসে দেখেন যে, কাফেলা চলে গেছে। তখন তিনি ছুটাছুটি না করে সেখানেই বসে পড়েন। এ আশায় যে কাফেলার রেখে যাওয়া মালামালের সন্ধানে নিয়োজিত কোন লোক আসবেন। অবশেষে এ কাজে নিয়োজিত সাফওয়ান (রা.) সকাল বেলায় আয়েশা (রা.) কে দেখতে পেলেন এবং নিজের উটে তাঁকে আরোহণ করিয়ে নিজে পায়ে হেটে উটের রশি টেনে সসম্মানে তাঁকে নিয়ে কাফেলার সাথে মিলিত হন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই কয়েকজনকে সাথে নিয়ে আয়েশা (রা.) এর ব্যাপারে মিথ্যা অপবাদ রটাতে থাকে। অবশেষে আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াতগুলো নাযিল করে আয়েশা (রা) কে নির্দোষ ঘোষণা করেন এবং অপবাদ রটনাকারীদের কঠোর শাস্তির কথা জানিয়ে দেন। এই ঘটনাটি ‘ইফক’ এর ঘটনা হিসেবে প্রসিদ্ধ।

Muhiuddin Khan

যারা মিথ্যা অপবাদ রটনা করেছে, তারা তোমাদেরই একটি দল। তোমরা একে নিজেদের জন্যে খারাপ মনে করো না; বরং এটা তোমাদের জন্যে মঙ্গলজনক। তাদের প্রত্যেকের জন্যে ততটুকু আছে যতটুকু সে গোনাহ করেছে এবং তাদের মধ্যে যে এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে, তার জন্যে রয়েছে বিরাট শাস্তি।

Zohurul Hoque

যারা কুৎসা রটনা করেছিল তারা তো তোমাদেরই মধ্যেকার একটি দল। এটিকে তোমাদের জন্য অনিষ্টকর মনে করো না, বরং এটি তোমাদের জন্য কল্যাণকর। তাদের প্রত্যেক লোকের জন্য রয়েছে পাপের যা সে অর্জন করেছে, আর তদের মধ্যের যে এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল তার জন্য রইছে কঠোর শাস্তি।