কুরআন মজীদ সূরা হাজ্জ্ব আয়াত ৩৬
Qur'an Surah Al-Hajj Verse 36
হাজ্জ্ব [২২]: ৩৬ ~ শব্দ অনুবাদ দ্বারা শব্দ
وَالْبُدْنَ جَعَلْنٰهَا لَكُمْ مِّنْ شَعَاۤىِٕرِ اللّٰهِ لَكُمْ فِيْهَا خَيْرٌۖ فَاذْكُرُوا اسْمَ اللّٰهِ عَلَيْهَا صَوَاۤفَّۚ فَاِذَا وَجَبَتْ جُنُوْبُهَا فَكُلُوْا مِنْهَا وَاَطْعِمُوا الْقَانِعَ وَالْمُعْتَرَّۗ كَذٰلِكَ سَخَّرْنٰهَا لَكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ (الحج : ٢٢)
- wal-bud'na
- وَٱلْبُدْنَ
- And the camels and cattle -
- এবং কুরবানির উটগুলো
- jaʿalnāhā
- جَعَلْنَٰهَا
- We have made them
- সেগুলোকে আমরা করেছি
- lakum
- لَكُم
- for you
- জন্যে তোমাদের
- min
- مِّن
- among
- অন্তর্ভুক্ত
- shaʿāiri
- شَعَٰٓئِرِ
- (the) Symbols
- নিদর্শনাবলীর
- l-lahi
- ٱللَّهِ
- (of) Allah
- আল্লাহর
- lakum
- لَكُمْ
- for you
- জন্যে তোমাদের রয়েছে
- fīhā
- فِيهَا
- therein
- তার মধ্যে
- khayrun
- خَيْرٌۖ
- (is) good
- কল্যাণ
- fa-udh'kurū
- فَٱذْكُرُوا۟
- So mention
- তাই (জবেহ করার সময়) উচ্চারণ করো
- is'ma
- ٱسْمَ
- (the) name
- নাম
- l-lahi
- ٱللَّهِ
- (of) Allah
- আল্লাহর
- ʿalayhā
- عَلَيْهَا
- over them
- তাদের উপর
- ṣawāffa
- صَوَآفَّۖ
- (when) lined up;
- সারিবদ্ধভাবে (দাঁড়ানো অবস্থায়)
- fa-idhā
- فَإِذَا
- and when
- অতঃপর যখন
- wajabat
- وَجَبَتْ
- are down
- কাত হয়ে পড়ে
- junūbuhā
- جُنُوبُهَا
- their sides
- তাদের পাশগুলো (অর্থাৎ প্রাণ নির্গত হয়)
- fakulū
- فَكُلُوا۟
- then eat
- তখন তোমরাখাও
- min'hā
- مِنْهَا
- from them
- তা হ'তে
- wa-aṭʿimū
- وَأَطْعِمُوا۟
- and feed
- এবং তোমরা খাওয়াও
- l-qāniʿa
- ٱلْقَانِعَ
- the needy who do not ask
- ধৈর্য্যশীল অভাবগ্রস্তকে
- wal-muʿ'tara
- وَٱلْمُعْتَرَّۚ
- and the needy who ask
- ও চায় এমন অভাবগ্রস্তকে
- kadhālika
- كَذَٰلِكَ
- Thus
- এভাবে
- sakharnāhā
- سَخَّرْنَٰهَا
- We have subjected them
- সেগুলোকে আমরা নিয়ন্ত্রিত করেছি
- lakum
- لَكُمْ
- to you
- জন্যে তোমাদের
- laʿallakum
- لَعَلَّكُمْ
- so that you may
- যাতে তোমরা
- tashkurūna
- تَشْكُرُونَ
- be grateful
- শোকর করো
Transliteration:
Walbudna ja'alnaahaa lakum min sha'aaa'iril laahi lakum feehaa khairun fazkurusmal laahi 'alaihaa sawaaff; fa izaa wajabat junoobuhaa fakuloo minhaa wa at'imul qaani'a walmu'tarr; kazaalika sakhkharnaahaa lakum la'allakum tashkuroon(QS. al-Ḥajj:36)
English Sahih International:
And the camels and cattle We have appointed for you as among the symbols [i.e., rites] of Allah; for you therein is good. So mention the name of Allah upon them when lined up [for sacrifice]; and when they are [lifeless] on their sides, then eat from them and feed the needy [who does not seek aid] and the beggar. Thus have We subjected them to you that you may be grateful. (QS. Al-Hajj, Ayah ৩৬)
তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):
আর (কুরবানীর) উটগুলোকে আমি করেছি আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্যতম। তাতে তোমাদের জন্য কল্যাণ আছে, কাজেই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো অবস্থায় ওগুলোর উপর তোমরা আল্লাহর নাম উচ্চারণ কর। যখন তা পার্শ্বভরে পড়ে যায়, তখন তাথেকে খাও আর যারা (ভিক্ষে না ক’রে) পরিতৃপ্ত থাকে তাদেরকে আর যারা কাকুতি মিনতি ক’রে যাচ্ঞা করে তাদেরকেও খাওয়াও। এভাবে আমি ওগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছি যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। (হাজ্জ্ব, আয়াত ৩৬)
Tafsir Ahsanul Bayaan
আর (কুরবানীর) উটকে[১] করেছি আল্লাহর (দ্বীনের) প্রতীকসমূহের অন্যতম; তোমাদের জন্য তাতে মঙ্গল রয়েছে। সুতরাং সারিবদ্ধভাবে দন্ডায়মান অবস্থায় ওগুলির উপর (নহর করার সময়) তোমরা আল্লাহর নাম নাও।[২] অতঃপর যখন ওরা কাত হয়ে পড়ে যায়[৩] তখন তোমরা তা হতে আহার কর[৪] এবং আহার করাও ধৈর্যশীল অভাবগ্রস্তকে ও যাঞ্চাকারী অভাবগ্রস্তকে।[৫] এইভাবে আমি ওদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছি; যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।
[১] بُدن শব্দটি بَدَنَة এর বহুবচন। এর অর্থ মোটা-তাজা দেহবিশিষ্ট পশু। কুরবানীর পশু সাধারণতঃ মোটা-তাজা হয় বলে তাকে بَدَنَة বলা হয়। ভাষাবিদগণ শুধু উটের জন্যই এ শব্দটিকে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু হাদীসের দৃষ্টিতে গরুর জন্যও بَدَنَة শব্দের ব্যবহার সঠিক। অর্থ এই যে, উট বা গরু যা কুরবানীর জন্য (মক্কায়) নিয়ে যাওয়া হয় তাও আল্লাহর দ্বীনের নিদর্শন ও প্রতীকসমূহের মধ্যে গণ্য। অর্থাৎ, তা আল্লাহর ঐ সকল নির্দেশের অন্তর্ভূত; যা মুসলিমদের জন্যই নিদৃষ্ট এবং তাঁদের বিশেষ চিহ্ন।
[২] صَوَافّ শব্দটি مَصفُوفَة এর অর্থে ব্যবহূত হয়েছে। অর্থাৎ, সারিবদ্ধভাবে দন্ডায়মান অবস্থায়। উটকে এভাবেই দাঁড়ানো অবস্থায় নহর করা হয়। তার সামনের বাম পা বেঁধে দেওয়া হয়; ফলে তিন পা খোলা অবস্থায় খাড়া থাকে।
[৩] অর্থাৎ, যখন দেহ থেকে রক্ত বের হয়ে গিয়ে তা মাটিতে কাত হয়ে পড়ে যায় এবং প্রাণত্যাগ করে, তখন তার গোশত কাটতে শুরু করো। কারণ জীবন্ত পশুর গোশত কেটে খাওয়া নিষিদ্ধ। মহানবী (সাঃ) বলেন, "জীবিত অবস্থায় কোন পশুর শরীর হতে কেটে নেওয়া গোশত মৃতের ন্যায় (হারাম)।" (আবূ দাঊদঃ শিকার অধ্যায়, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)
[৪] কিছু উলামার নিকট এই আদেশের মান ওয়াজেব। অর্থাৎ, কুরবানীর গোশত খাওয়া কুরবানীকারীর জন্য জরুরী। তবে অধিকাংশ উলামাগণের নিকট উক্ত আদেশের মান মুস্তাহাব বা জায়েয। অর্থাৎ, কুরবানীকৃত পশুর গোশত খাওয়া উত্তম। অতএব কেউ যদি সম্পূর্ণ গোশ্ত্কে বিলি করে দেয় এবং কিছু মাত্রও না খায়, তাহলে তাতেও কোন দোষ নেই।
[৫] قَانِع এর অর্থ ভিক্ষুক। এর অন্য একটি অর্থ অল্পে তুষ্ট ব্যক্তি। অর্থাৎ, অভাবী কিন্তু ভিক্ষা করে না বা কারো কাছে কিছু চায় না। আর مُعتَرّ শব্দের অর্থ (যাঞ্চাকারী অভাবগ্রস্ত) কেউ কেউ করেছেন, বিনা যাঞ্চায় আগত ব্যক্তি। আর কেউ قَانِع এর অর্থ ভিক্ষুক আর مُعتَرّ এর অর্থ অতিথি করেছেন। যাই হোক, এই আয়াত দ্বারা দলীল নিয়ে বলা হয় যে, কুরবানীর গোশ্ত্কে তিন ভাগ করা উচিত; একভাগ নিজে খাওয়ার জন্য, দ্বিতীয় ভাগ অতিথি ও আত্মীয়-স্বজনদের খাওয়ার জন্য এবং তৃতীয় ভাগ ভিক্ষুক ও সমাজের অভাবগ্রস্তদের জন্য। এ কথার সমর্থনে এই হাদীসটি তুলে ধরা হয়, যাতে মহানবী (সাঃ) বলেছেন, "আমি তোমাদেরকে তিন দিনের বেশি কুরবানীর গোশত রাখতে নিষেধ করেছিলাম, এখন তোমাদেরকে অনুমতি দিচ্ছি তোমরা খাও, প্রয়োজন মত জমা রাখো।" অন্য একটি বর্ণনার শব্দাবলী এই, "খাও, সা'দক্বা কর ও জমা রাখো।" আর একটি বর্ণনায় এসেছে, "খাও, খাওয়াও ও সা'দক্বা কর।" (বুখারীঃ কুরবানী অধ্যায়, মুসলিম, সুনান) কেউ কেউ দু'ভাগ করার কথা বলেন, অর্ধেক নিজের জন্য ও বাকী অর্ধেক সা'দক্বার জন্য। এঁরা এর আগের (২২;২৮ নং) আয়াত {فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْبَائِسَ الْفَقِيرَ} (অতঃপর তোমরা তা হতে আহার কর এবং দুঃস্থ, অভাবগ্রস্তকে আহার করাও) থেকে দলীল গ্রহণ করেন। কিন্তু সত্য কথা এই যে, কোন আয়াত বা হাদীস দ্বারা নিক্তি ধরে এ রকম দু'ভাগ বা তিনভাগ করার কথা বোঝা যায় না। বরং সাধারণভাবে তা খাওয়া ও খাওয়ানোর কথাই বলা হয়েছে। অতত্রব এই সাধারণ নির্দেশকে সাধারণ রাখাই উচিত এবং ভাগাভাগির কোন নিয়ম বেঁধে দেওয়া উচিত নয়। অবশ্য কুরবানীর চামড়ার ব্যাপারে সকলেই একমত যে, তা নিজে ব্যবহার কর কিংবা সা'দক্বা করে দাও, বিক্রি করার অনুমতি নেই; যেমন হাদীসে আছে। (আহমাদ ৪/১৫) তবে কিছু উলামা চামড়া বিক্রি করে তার মূল্য গরীবদের মাঝে বন্টন করার অনুমতি দিয়েছেন। (ইবনে কাসীর)
বিঃদ্রঃ- কুরআন কারীমে এখানে কুরবানীর বর্ণনা হজ্জের মাসআলার সঙ্গে আনুষঙ্গিকভাবে এসেছে। যার ফলে হাদীস অস্বীকারকারীরা এই প্রমাণ করতে চায় যে, কুরবানী শুধুমাত্র হাজীদের জন্য; অন্যান্য মুসলিমদের জন্য তা জরুরী নয়। কিন্তু এ কথা সত্য নয়। কারণ অন্য জায়গায় ব্যাপকভাবে কুরবানীর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যেমন {فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ} অর্থাৎ নিজ প্রভুর জন্য নামায পড় ও কুরবানী কর। (সূরা কাউসার) আর মহানবী (সাঃ) এই আয়াতের মর্মার্থ কার্যতঃ এভাবে ব্যক্ত করেছেন যে, মদীনার জীবনে প্রতি বছর ১০ই যিল-হজ্জ কুরবানী করেছেন এবং মুসলিমদেরকে কুরবানী করতে তাকীদ করেছেন। সেহেতু সাহাবা (রাঃ)গণও কুরবানী করেছেন। তাছাড়া মহানবী (সাঃ) যেখানে কুরবানী সম্পর্কে বেশ কিছু উপদেশ দিয়েছেন সেখানে তিনি একথাও বলেছেন যে, ১০ই যিলহজ্জ আমরা সর্বপ্রথম নামায পড়ব, তারপর কুরবানীর পশু যবেহ করব। আর যে ব্যক্তি ঈদের নামাযের আগেই কুরবানী করল। সে গোশত খাওয়ার ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করল; তার কুরবানী হল না। (বুখারীঃ ঈদ অধ্যায়, মুসলিমঃ কুরবানী অধ্যায়) এখান থেকে পরিষ্কার যে কুরবানীর আদেশ প্রত্যেক মুসলিমের জন্য; সে যেখানেই থাক। কারণ হাজীগণ তো ঈদের নামাযই পড়েন না। অতএব এখান থেকেও স্পষ্ট হয় যে, এ নির্দেশ হাজী ছাড়া অন্যদের জন্য। তবে কুরবানী করা ওয়াজেব নয়; সুন্নাতে মুআক্কাদাহ্। ঠিক অনুরূপ লোক দেখানোর জন্য বেশ কয়েকটি কুরবানী করাও সুন্নাহর পরিপন্থী। যেহেতু হাদীসানুসারে একটি পরিবারের সকলের তরফ হতে কেবল একটি পশুই যথেষ্ট। সাহাবাদের আমলও অনুরূপ ছিল। (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)
Tafsir Abu Bakr Zakaria
আর উট [১] কে আমরা আল্লাহ্র নিদর্শনগুলোর অন্যতম করেছি [২]; তোমাদের জন্য তাতে অনেক মঙ্গল রয়েছে [৩]। কাজেই এক পা বাঁধা ও বাকী তিনপায়ে দাঁড়ানো অবস্থায় তাদের উপর তোমরা আল্লাহ্র নাম উচ্চারণ কর [৪]। তারপর যখন তারা কাত হয়ে পড়ে যায় [৫] তখন তোমরা তা থেকে খাও এবং আহার করাও ধৈর্যশীল অভাবগ্রস্থকে ও সাহায্যপ্রার্থীদেরকে [৬]; এভাবে আমরা সেগুলোকে তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছি যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।
[১] মুলে البُدْن শব্দটি এসেছে। আরবী ভাষায় তা শুধুমাত্র উটের জন্য ব্যবহার করা হয়। [কুরতুবী] সাধারণতঃ ঐ উটকেই بدن বলা হয় যা কা‘বার জন্য ‘হাদঈ’ হিসেবে প্রেরণ করা হয়। আর ‘হাদঈ’ হচ্ছে, উট, গরু, ছাগল সবগুলোর জন্য ব্যবহৃত নাম। [কুরতুবী] তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরবানীর বিধানে গরুকেও উটের হুকুমের সাথে শামিল করেছেন। একটি উট কুরবানী করলে যেমন তা সাতজনের জন্য যথেষ্ট, ঠিক তেমনি সাত জন মিলে একটি গরু কুরবানী দিতে পারে। হাদীসে এসেছে, জাবের ইবন আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের হুকুম দিয়েছেন আমরা যেন কুরবানীতে উটের ক্ষেত্রে সাতজন এবং গরুর ক্ষেত্রে সাতজন শরীক হয়ে যাই।” [মুসলিমঃ ১২১৩] হজ্জের হাদঈতেও কুরবানীর মত একটি গরু, মহিষ ও উটে সাতজন শরীক হতে পারে। [কুরতুবী]
[২] পূর্বে বর্ণিত হয়েছে যে, দ্বীন ইসলামের আলামতরূপে গণ্য হয়, এমন বিশেষ বিধি-বিধান ও ইবাদাতকে شعادٔر বলা হয়। হাদঈ যবেহ করা এমন বিধানাবলীর অন্যতম। কাজেই এ ধরণের বিধানসমূহ পালন করা অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
[৩] অর্থাৎ তোমরা তা থেকে ব্যাপকহারে কল্যাণ লাভ করে থাকো। দ্বীন ও দুনিয়ার সার্বিক উপকারিতা তাতে রয়েছে। এখানে কেন হাদঈ যবাই করতে হবে সেদিকে ইংগিত করা হয়েছে। মানুষ আল্লাহ্ প্রদত্ত যেসব জিনিস থেকে লাভবান হয় তার মধ্য থেকে প্রত্যেকটিই আল্লাহ্র নামে কুরবানী করা উচিত, শুধুমাত্র নিয়ামতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য নয় বরং আল্লাহ্র শ্রেষ্ঠত্ব ও মালিকানার স্বীকৃতি দেবার জন্যও, যাতে মানুষ মনে মনে ও কার্যত একথা স্বীকার করে যে, আল্লাহ্ আমাকে যা কিছু দিয়েছেন এ সবই তাঁর। তারপরও এর মাধ্যমে মানুষ দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ লাভ করে থাকে। মুজাহিদ বলেন, এতে যেমন সওয়াব রয়েছে তেমনি রয়েছে উপকার। [ইবন কাসীর] দুনিয়ার উপকারিতা যেমন, খাওয়া, সদকা, ভোগ করা ইত্যাদি। [সা’দী] ইবরাহীম নাখা‘য়ী বলেন, যদি প্রয়োজন হয় তার উপর সওয়ার হতে পারবে এবং দুধ দুইয়ে খেতে পারবে। [ইবন কাসীর] আর আখেরাতের কল্যাণ তো আছেই।
[৪] صَوَافَّ শব্দের অর্থ তিন পায়ে ভর দিয়ে দণ্ডায়মান থাকবে এবং এক পা বাঁধা থাকবে। উটের জন্য এই নিয়ম। [কুরতুবী; ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর] দণ্ডায়মান অবস্থায় উট কুরবানী করা সুন্নত ও উত্তম। অবশিষ্ট সব জন্তুকে শোয়া অবস্থায় যবেহ করা সুন্নত। [দেখুন, কুরতুবী] তাউস ও হাসান صَوَافَّ শব্দটির অর্থ করেছেন, খালেসভাবে। অর্থাৎ একান্তভাবে আল্লাহ্র জন্য। তাঁর নামের সাথে আর কারও নাম নিও না। [ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর] এখানে “তাদের উপর আল্লাহ্র নাম নাও’’ বলে আল্লাহ্র নামে যবাই করার কথা বলা হয়েছে। ইসলামী শরী‘আতে আল্লাহ্র নাম না নিয়ে পশু যবেহ করার কোন অবকাশ নেই। তাছাড়া এখানে নাম নেয়ার অর্থ শুধু নাম উচ্চারণ নয় বরং মনে-প্ৰাণে আল্লাহ্র জন্য এবং তাঁরই নামে যবাই করা বুঝাবে। যদি কেউ আল্লাহ্র নাম উচ্চারণ করে এবং অন্য কোন ব্যক্তি যথা পীর, কবর, মাজার, জিন ইত্যাদির সন্তুষ্টি লাভের ইচ্ছা পোষণ করে তবে তা সম্পূর্ণভাবে হারাম ও শির্ক বলে বিবেচিত হবে।
[৫] এখানে وَجَبَتْ অর্থ سَقَطَتْ বা পড়ে যাওয়া করা হয়েছে। যেমন বাকপদ্ধতিতে বলা হয় الشَّمْسُ وَجَبَتْ অর্থাৎ সূর্য ঢলে পড়েছে। এখানে জন্তুর প্রাণ নিৰ্গত হওয়া বোঝানো হয়েছে। [কুরতুবী; ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর] সুতরাং সম্পপূর্ণভাবে রূহ নিৰ্গত না হওয়া পর্যন্ত প্রাণী থেকে কিছু খাওয়া জায়েয নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “নিশ্চয় আল্লাহ্ প্রতিটি বস্তুর উপর দয়া লিখে দিয়েছেন। সুতরাং যখন তোমরা হত্যা করবে, তখন সুন্দরভাবে তা কর। আর যখন যবাই করবে তখন সুন্দরভাবে তা কর। তোমাদের কেউ যেন তার ছুরিটি ধার দিয়ে নেয় এবং যবেহকৃত প্রাণীটিকে শান্তি দেয়।’’ [আবু দাউদঃ ২৮১৫]
[৬] যাদেরকে হাদঈ ও কুরবানীর গোশত দেয়া উচিত, পূর্ববতী আয়াতে তাদেরকে بادٔس বলা হয়েছে। এর অর্থ দুঃস্থ, অভাবগ্ৰস্ত। এই আয়াতে তদস্থলে مُعْتَرّ ও قَانِعٌ শব্দদ্বয়ের দ্বারা তার তাফসীর করা হয়েছে। قَانِعٌ ঐ অভাবগ্ৰস্ত ফকীরকে বলা হয়, যে কারো কাছে যাচঞা করে না, দারিদ্র্য সত্ত্বেও স্বস্থানে বসে থাকে এবং কেউ কিছু দিলে তাতেই সন্তুষ্ট থাকে। পক্ষান্তরে مُعْتَرّ ঐ ফকীরকে বলা হয়, যে কিছু পাওয়ার আশায় অন্যত্র গমন করে-মুখে সওয়াল করুক বা না করুক। [দেখুন, ইবন কাসীর]
Tafsir Bayaan Foundation
আর কুরবানীর উটকে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন বানিয়েছি; তোমাদের জন্য তাতে রয়েছে কল্যাণ। সুতরাং সারিবদ্ধভাবে দন্ডায়মান অবস্থায় সেগুলির উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ কর যখন সেগুলি কাত হয়ে পড়ে যায় তখন তা থেকে খাও। যে অভাবী, মানুষের কাছে হাত পাতে না এবং যে অভাবী চেয়ে বেড়ায়-তাদেরকে খেতে দাও। এভাবেই আমি ওগুলিকে তোমাদের অনুগত করে দিয়েছি; যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।
Muhiuddin Khan
এবং কা’বার জন্যে উৎসর্গীকৃত উটকে আমি তোমাদের জন্যে আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন করেছি। এতে তোমাদের জন্যে মঙ্গল রয়েছে। সুতরাং সারিবদ্ধভাবে বাঁধা অবস্থায় তাদের যবেহ করার সময় তোমরা আল্লাহর নাম উচ্চারণ কর। অতঃপর যখন তারা কাত হয়ে পড়ে যায় তখন তা থেকে তোমরা আহার কর এবং আহার করাও যে কিছু যাচ্ঞা করে না তাকে এবং যে যাচ্ঞা করে তাকে। এমনিভাবে আমি এগুলোকে তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছি, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।
Zohurul Hoque
আর উট, -- আমরা তাদের তোমাদের জন্য আল্লাহ্র নিদর্শনাবলীর অন্যতম বানিয়েছি, তোমাদের জন্য তাদের মধ্যে কল্যাণ নিহিত আছে। সেজন্য সারিবদ্ধ থাকাকালে তাদের উপরে আল্লাহ্র নাম উল্লেখ করো, তারপর তারা যখন তাদের পার্শ্বে পড়ে যায় তখন তা থেকে তোমরা খাও, এবং খাওয়াও তুষ্ট-দুঃস্থকে ও ভিক্ষুককে। এইভাবেই আমরা এদের তোমাদের অধীন করে দিয়েছি যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।