Skip to content

কুরআন মজীদ সূরা ইব্রাহীম আয়াত ৩৭

Qur'an Surah Ibrahim Verse 37

ইব্রাহীম [১৪]: ৩৭ ~ শব্দ অনুবাদ দ্বারা শব্দ

رَبَّنَآ اِنِّيْٓ اَسْكَنْتُ مِنْ ذُرِّيَّتِيْ بِوَادٍ غَيْرِ ذِيْ زَرْعٍ عِنْدَ بَيْتِكَ الْمُحَرَّمِۙ رَبَّنَا لِيُقِيْمُوا الصَّلٰوةَ فَاجْعَلْ اَفْـِٕدَةً مِّنَ النَّاسِ تَهْوِيْٓ اِلَيْهِمْ وَارْزُقْهُمْ مِّنَ الثَّمَرٰتِ لَعَلَّهُمْ يَشْكُرُوْنَ (ابراهيم : ١٤)

rabbanā
رَّبَّنَآ
Our Lord!
হে আমাদের রব
innī
إِنِّىٓ
Indeed, I
নিশ্চয়ই আমি
askantu
أَسْكَنتُ
[I] have settled
বসবাস করিয়েছি
min
مِن
(some) of
থেকে (কতককে)
dhurriyyatī
ذُرِّيَّتِى
my offsprings
আমার বংশধরদের
biwādin
بِوَادٍ
in a valley
উপত্যকায়
ghayri
غَيْرِ
not
নয়
dhī
ذِى
with
যোগ্য
zarʿin
زَرْعٍ
cultivation
চাষাবাদ
ʿinda
عِندَ
near
কাছে
baytika
بَيْتِكَ
Your Sacred House
তোমার ঘরের
l-muḥarami
ٱلْمُحَرَّمِ
Your Sacred House
(যা) মহান সম্মানিত
rabbanā
رَبَّنَا
our Lord!
হে আমাদের রব
liyuqīmū
لِيُقِيمُوا۟
That they may establish
যেন তারা প্রতিষ্ঠা করে
l-ṣalata
ٱلصَّلَوٰةَ
the prayers
সালাত
fa-ij'ʿal
فَٱجْعَلْ
So make
অতএব বানাও
afidatan
أَفْـِٔدَةً
hearts
অন্তরসমূহ
mina
مِّنَ
of
কিছু
l-nāsi
ٱلنَّاسِ
the men
মানুষের
tahwī
تَهْوِىٓ
incline
অনুরক্ত হয় (যেন)
ilayhim
إِلَيْهِمْ
towards them
দিকে তাদের
wa-ur'zuq'hum
وَٱرْزُقْهُم
and provide them
এবং তাদেরকে জীবিকা দাও
mina
مِّنَ
with
থেকে
l-thamarāti
ٱلثَّمَرَٰتِ
the fruits
ফল-মূলসমূহ
laʿallahum
لَعَلَّهُمْ
so that they may
তারা যাতে
yashkurūna
يَشْكُرُونَ
be grateful
কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে

Transliteration:

Rabbanaaa inneee askantu min zurriyyatee biwaadin ghairi zee zar'in 'inda Baitikal Muharrami Rabbanaa liyuqeemus Salaata faj'al af'idatam minan naasi tahweee ilaihim warzuqhum minas samaraati la'allahum yashkuroon (QS. ʾIbrāhīm:37)

English Sahih International:

Our Lord, I have settled some of my descendants in an uncultivated valley near Your sacred House, our Lord, that they may establish prayer. So make hearts among the people incline toward them and provide for them from the fruits that they might be grateful. (QS. Ibrahim, Ayah ৩৭)

তাফসীর তাইসীরুল কুরআন (Taisirul Quran):

হে আমাদের প্রতিপালক! আমি আমার সন্তানদের একাংশকে শস্যক্ষেতহীন উপত্যকায় তোমার সম্মানিত ঘরের নিকট পুনর্বাসিত করলাম। হে আমার প্রতিপালক! তারা যাতে নামায কায়িম করে। কাজেই তুমি মানুষের অন্তরকে তাদের প্রতি অনুরাগী করে দাও আর ফল-ফলাদি দিয়ে তাদের জীবিকার ব্যবস্থা কর যাতে তারা শুকরিয়া আদায় করে। (ইব্রাহীম, আয়াত ৩৭)

Tafsir Ahsanul Bayaan

হে আমাদের প্রতিপালক! আমি আমার কিছু বংশধরকে[১] ফল-ফসলহীন উপত্যকায় তোমার পবিত্র গৃহের নিকট বসবাস করালাম; হে আমাদের প্রতিপালক! যাতে তারা নামায কায়েম করে।[২] সুতরাং তুমি কিছু লোকের[৩] অন্তরকে ওদের প্রতি অনুরাগী করে দাও এবং ফলমূল দ্বারা তাদের জীবিকার ব্যবস্থা কর;[৪] যাতে তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।

[১] مِنْ ذُرِّيَّتِيْ তে مِنْ তাব'ঈযের (অর্থাৎ আংশিক অর্থ প্রকাশের) জন্য ব্যবহূত হয়েছে। অর্থাৎ কিছু বংশধরকে। বলা হয় যে, ইবরাহীম (আঃ)-এর ঔরসজাত ছেলে আটজন, তাদের মধ্যে শুধু ইসমাঈল (আঃ)-কে এখানে বসবাস করিয়েছিলেন। (ফাতহুল কাদীর)

[২] ইবাদতসমূহের মধ্যে শুধু নামাযের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে নামাযের গুরুত্ব প্রকাশ পায়।

[৩] এখানেও مِنْ তাব'ঈযের (অর্থাৎ আংশিক অর্থ প্রকাশের) জন্য ব্যবহূত হয়েছে। অর্থাৎ, কিছু লোকের; উদ্দেশ্য মুসলিমগণ। সুতরাং দেখে নিন যে, কিভাবে নিখিল বিশ্বের মুসলিমরা মক্কা মুকার্রামায় একত্রিত হয়ে থাকে এবং হজ্জের মৌসম ছাড়াও সারা বছর এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে। যদি ইবরাহীম (আঃ) أفْئِدَةَ النَّاسِ (মানুষের অন্তর) বলতেন, তাহলে খ্রিষ্টান, ইয়াহুদী, অগ্নিপূজক এবং অন্যান্য সমস্ত মানুষ মক্কা পৌঁছত। مِنَ النَّاسِ এর مِنْ শব্দটি এই দু'আকে মুসলমান পর্যন্ত সীমিত করে দিয়েছে। (ইবনে কাসীর)

[৪] এ দু'আরও প্রভাব লক্ষণীয় যে, মক্কার মত বৃক্ষ-পানিহীন অনাবাদ জায়গাতে যেখানে কোন ফলদার বৃক্ষ ছিল না, আজ সেখানে বিভিন্ন প্রকারের ফলমূল পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায়। হজ্জের মৌসুমেও ফল-ফ্রুটের কোন প্রকার ঘাটতি হয় না, অথচ লক্ষ লক্ষ মানুষ সেখানে উপস্থিত হয়। এটা মহান আল্লাহর খলীল ইবরাহীম (আঃ)-এর দু'আর বদৌলতে তাঁর (আল্লাহর) পক্ষ থেকে দয়া, কৃপা, অনুগ্রহ, অনুকম্পা ও বরকত। বলা হয় যে, তিনি উক্ত দু'আ কা'বাঘর নির্মাণ করার পর করেছিলেন। পক্ষান্তরে প্রথম দু'আটি (নিরাপদ কর) সেই সময় করেছিলেন, যখন স্বীয় স্ত্রী ও নবজাত শিশু ইসমাঈলকে আল্লাহর নির্দেশে সেখানে রেখে চলে গিয়েছিলেন। (ইবনে কাসীর)

Tafsir Abu Bakr Zakaria

হে আমাদের রব! আমি আমার বংশধরদের কিছু সংখ্যককে বসবাস করালাম [১] অনুর্বর উপত্যকায় [২] আপনার পবিত্র ঘরের কাছে [৩], হে আমাদের রব! এ জন্য যে, তারা যেন সালাত কায়েম করে [৪]। অতএব আপনি কিছু লোকের অন্তর তাদের প্রতি অনুরাগী করে দিন [৫] এবং ফল-ফলাদি দিয়ে তাদের রিযকের ব্যবস্থা করুন [৬], যাতে তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে [৭]।

[১] এখানে ইবরাহীম আলাইহিসসালাম কিভাবে তার স্ত্রী ও একমাত্র সন্তানকে এ মরুপ্রান্তরে রেখে গেলেন সে ঘটনাটি সহীহ বর্ণনার উপর নির্ভর করে বর্ণনা করা প্রয়োজন। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ নারী জাতি সর্বপ্রথম ইসমাঈল আলাইহিসসালাম এর মাতা হাজেরা থেকেই কোমরবন্ধ বানানো শিখেছে। হাজেরা সারা থেকে আপন গর্ভের নিদর্শনাবলী গোপন করার উদ্দেশ্যেই কোমরবন্ধ লাগাতেন। অতঃপর উভয়ের মনোমালিণ্য চরমে পৌছলে আল্লাহর আদেশে ইবরাহীম আলাইহিসসালাম হাজেরা ও তার শিশুপুত্র ইসমাইলকে সাথে নিয়ে নির্বাসন দানের জন্য বের হলেন। পথে হাজেরা শিশুকে দুধ পান করাতেন। শেষ পর্যন্ত ইবরাহীম আলাইহিসসালাম তাদের উভয়কে নিয়ে যেখানে কাবাঘর অবস্থিত সেখানে এসে উপস্থিত হলেন এবং মসজিদের উচু অংশে যমযমের উপরিস্থত এক বিরাট বৃক্ষতলে তাদেরকে রাখলেন। তখন মক্কায় না ছিল কোন জনমানব, না ছিল পানির কোনরূপ ব্যবস্থা। অতঃপর সেখানেই তাদেরকে রেখে গেলেন এবং একটি থলের মধ্যে কিছু খেজুর আর একটি মশকে স্বল্প পরিমাণ পানি দিয়ে গেলেন। তারপর ইবরাহীম আলাইহিসসালাম নিজ গৃহ অভিমুখে ফিরে চললেন। ইসমাঈলের মাতা তার পিছু পিছু ছুটে আসলেন এবং চিৎকার করে বলতে লাগলেন, হে ইবরাহীম! কোথায় চলে যাচ্ছেন? আর আমাদেরকে রেখে যাচ্ছেন এমন এক ময়দানে, যেখানে না আছে কোন সাহায্যকারী না আছে পানাহারের কোন বস্তু। তিনি বার বার এ কথা বলতে লাগলেন। কিন্ত ইবরাহীম আলাইহিসসালাম সেদিকে ফিরেও তাকালেন না। তখন হাজেরা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, এর আদেশ কি আপনাকে আল্লাহ দিয়েছেন? তিনি জবাব দিলেন, হ্যাঁ। হাজেরা বললেন, তাহলে আল্লাহ আমাদের ধ্বংস ও বরবাদ করবেন না। তারপর তিনি ফিরে আসলেন। ইবরাহীমও সামনে চললেন। শেষ পর্যন্ত যখন তিনি গিরিপথের বাঁকে এসে পৌছলেন, যেখানে স্ত্রী-পুত্র আর তাকে দেখতে পাচ্ছিল না, তখন তিনি কাবা ঘরের দিকে মুখ করে দাঁড়ালেন এবং দু’হাত তুলে এ দোআ করলেনঃ

“হে আমাদের রব ! আমি আমার বংশধরদের কিছু সংখ্যককে বসবাস করালাম অনুর্বর উপত্যকায় আপনার পবিত্র ঘরের কাছে, হে আমাদের রব ! এ জন্যে যে, তারা যেন সালাত কায়েম করে। অতএব আপনি কিছু লোকের অন্তর তাদের প্রতি অনুরাগী করে দিন এবং ফল-ফলাদি দিয়ে তাদের রিযকের ব্যবস্থা করুন, যাতে তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।" তখন ইসমাঈলের মা ইসমাঈলকে দুধ খাওয়াতেন আর নিজে ঐ মশক থেকে পানি পান করতেন। পরিশেষে মশকে যা পানি ছিল তা ফুরিয়ে গেল। তখন তিনি নিজেও তৃষ্ণার্ত হলেন এবং তার শিশুপুত্রটিও পিপাসায় কাতর হয়ে পড়ল। তিনি শিশুর প্রতি দেখতে লাগলেন, শিশুর বুক ধড়ফড় করছে কিংবা বলেছেন, সে জমিনে ছটফট করছে। শিশুপুত্রের দিকে তাকানো তার পক্ষে অসহনীয় হয়ে উঠল। তিনি সরে পড়লেন এবং তাঁর অবস্থানের সংলগ্ন পর্বত সাফা’কেই একমাত্র নিকটতম পর্বত হিসেবে পেলেন তারপর তিনি এর উপর উঠে দাঁড়িয়ে ময়দানের দিকে মুখ করলেন, এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখলেন কাউকে দেখা যায় কি না? কিন্তু না কাউকে তিনি দেখলেন না। তখন দ্রুত সাফা পর্বত থেকে নেমে পড়লেন। যখন তিনি নিচু ময়দানে পৌছলেন তখন আপন কামিজের এক দিক তুলে একজন শ্রান্ত-ক্লান্ত ব্যক্তির ন্যায় দৌড়ে চললেন। শেষে ময়দান অতিক্রম করলেন, মারওয়া পাহাড়ের নিকট এসে গেলেন এবং তার উপর উঠে দাঁড়ালেন। তারপর চারদিকে নজর করলেন, কাউকে দেখতে পান কি না? কিন্তু কাউকে দেখলেন না তিনি অনুরূপভাবে সাতবার করলেন। ... তারপর যখন তিনি শেষবার মারওয়ার পাহাড়ের উপর উঠলেন, একটি আওয়াজ শুনলেন। তখন নিজেকেই নিজে বললেন, একটু অপেক্ষা কর। তিনি কান দিলেন। আবারও শব্দ শুনলেন। তখন বললেন, তোমার আওয়াজ তো শুনছি। যদি তোমার কাছে উদ্ধার করার মত কিছু থাকে আমাকে উদ্ধার কর। অকস্মাৎ তিনি, যমযম যেখানে অবস্থিত সেখানে একজন ফেরেশতাকে দেখতে পেলেন। সে ফেরেশতা আপন পায়ের গোড়ালি দ্বারা আঘাত করলেন। কিংবা তিনি বলেছেন-আপন ডানা দ্বারা আঘাত হানলেন। ফলে (আঘাতের স্থান থেকে) পানি উপচে উঠতে লাগল। হাজেরা এর চার পাশে বাঁধ দিয়ে তাকে হাউযের আকার দান করলেন এবং অঞ্জলি ভরে তার মশকটিতে পানি ভরতে লাগলেন। হাজেরার অঞ্জলি ভরার পরে পানি উছলে উঠতে লাগল। ... তারপর হাজেরা পানি পান করলেন এবং শিশুপুত্রকেও দুধ পান করালেন। তখন ফেরেশতা তাকে বললেন, ধ্বংসের কোন আশংকা আপনি করবেন না। কেননা, এখানেই আল্লাহর ঘর রয়েছে। এই শিশু তার পিতার সাথে মিলে এটি পুনঃ নিৰ্মাণ করবে এবং আল্লাহ তার পরিজনকে কখনও ধ্বংস করবেন না। ঐ সময় বায়তুল্লাহ জমিন থেকে টিলার ন্যায় উচু ছিল। বন্যার পানি আসতো এবং ডান বাম থেকে ভেঙ্গে নিয়ে যেতো।

হাজেরা এভাবেই দিন-যাপন করছিলেন। শেষ পর্যন্ত “জুরহুম” গোত্রের একদল লোক তাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে গেল। কিংবা তিনি বলেছেন, ‘জুরহুম' গোত্রের কিছু লোক ‘কাদা’ এর পথে এ দিক দিয়ে আসছিল। তারা মক্কার নিচুভূমিতে অবতরণ করল এবং দেখতে পেল কতগুলো পাখি চক্রাকারে উড়ছে। তখন তারা বলল, নিশ্চয় এ পাখিগুলো পানির উপরই ঘুরছে। অথচ আমরা এ ময়দানে বহুকাল কাটিয়েছি। কিন্তু কোন পানি এখানে ছিল না। তারপর তারা একজন বা দু'জন লোক সেখানে পাঠাল। তারা গিয়েই পানি দেখতে পেল। ফিরে এসে সবাইকে পানির খবর দিল। সবাই সেদিকে অগ্রসর হলো। বর্ণনাকারী বলেনঃ

ইসমাঈলের মাতা পানির কাছে বসা ছিলেন। তারা তাকে জিজ্ঞেস করল, আমরা আপনার নিকটবর্তী স্থানে বসবাস করতে চাই; আপনি আমাদেরকে অনুমতি দিবেন কি? তিনি জবাব দিলেন, হ্যাঁ, তবে এ পানির উপর তোমাদের কোন অধিকার থাকবে না। তারা হ্যাঁ বলে সম্মতি জানালো।

ইবনে আব্বাস বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, এ ঘটনা ইসমাঈলের মাতার জন্য এক সুবর্ণ সুযোগ এনে দিল, তিনিও মানুষের সাহচর্য কামনা করছিলেন। ফলে আগন্তুক দলটি সেখানে বসতি স্থাপন করলো এবং পরিবার-পরিজনের কাছে খবর পাঠালো, তারাও এসে সেখানে বসবাস শুরু করল। শেষ পর্যন্ত সেখানে তাদের কয়েকটি খান্দান জন্ম নিল। ইসমাঈলও বড় হলেন, তাদের থেকে আরবী শিখলেন। জওয়ান হলে তিনি তাদের অধিক আগ্রহের বস্তু ও প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলেন। যখন তিনি যৌবনপ্রাপ্ত হলেন, তখন তারা তাদেরই এক মেয়েকে তার সঙ্গে বিয়ে দিল। বিয়ের পরে ইসমাঈলের মাতা মারা গেলেন। ... (ইতিমধ্যে ইবরাহীম আলাইহিসসালাম দু’বার এসে ইসমাঈল ও স্ত্রীর খোজ নিলেন এবং এ ব্যাপারে দিক নির্দেশনা দিলেন)

পুনরায় ইবরাহীম আলাইহিসসালাম আল্লাহর ইচ্ছায় কিছু দিন এদের থেকে দূরে রইলেন। এরপর আবার তাদের কাছে আসলেন। ইসমাঈল আলাইহিসসালাম যমযমের কাছে একটি গাছের নীচে বসে নিজের তীর মেরামত করছিলেন। পিতাকে যখন আসতে দেখলেন, দাঁড়িয়ে তার দিকে এগিয়ে গেলেন। অতঃপর একজন পিতা-পুত্রের সঙ্গে সাক্ষাত হলে যা করে তারা তা-ই করলেন।

তারপর ইবরাহীম আলাইহিসসালাম বললেনঃ হে ইসমাঈল। আল্লাহ আমাকে একটি কাজের হুকুম দিয়েছেন। ইসমাঈল আলাইহিসসালাম জবাব দিলেন, আপনার পরওয়ারদিগার আপনাকে যা আদেশ করেছেন তা করে ফেলুন।

ইবরাহীম আলাইহিসসালাম বললেনঃ তুমি আমাকে সাহায্য করবে কি? ইসমাঈল আলাইহিসসালাম বললেন, হ্যাঁ। আমি অবশ্যই আপনার সাহায্য করব ইবরাহীম আলাইহিসসালাম বললেন, আল্লাহ আমাকে এখানে এর চারপাশ ঘেরাও করে একটি ঘর বানানোর নির্দেশ দিয়েছেন। এ বলে তিনি উচু টিলাটির দিকে ইশারা করলেন এবং স্থানটি দেখালেন। তখনি তারা উভয়ে কাবা ঘরের দেয়াল উঠাতে লেগে গেলেন। ইসমাঈল আলাইহিসসালাম পাথর যোগান দিতেন এবং ইবরাহীম আলাইহিসসালাম গাথুনি করতেন। যখন দেয়াল উচু হয়ে গেল, তখন ইসমাঈল আলাইহিসসালাম মাকামে ইবরাহীম নামক মশহুর পাথরটি আনলেন এবং ইবরাহীম আলাইহিসসালামের জন্য তা যথাস্থানে রাখলেন। ইবরাহীম আলাইহিসসালাম এর উপর দাঁড়িয়ে ইমারত নির্মাণ করতে লাগলেন এবং ইসমাঈল তাকে পাথর যোগান দিতে লাগলেন। আর উভয়ে এ দো'আ করতে থাকলেনঃ

“হে আমাদের রব! আমাদের থেকে (এ কাজটুকু) কবুল করুন। নিশ্চয়ই আপনি সবকিছু শুনেন ও জানেন"। আবার তারা উভয়ে ইমারত নির্মাণ করতে লাগলেন। তারা কাবা ঘরের চারদিকে ঘুরছিলেন এবং উভয়ে এ দো'আ করছিলেনঃ

“হে আমাদের প্রভু! আমাদের এ শ্রমটুকু কবুল করে নিন। নিশ্চয়ই আপনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।" (সূরা আল-বাকারাহঃ ১২৭), [বুখারীঃ ৩৩৬৪]

[২] ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ পান যে, দুগ্ধপোষ্য শিশু ও তার জননীকে শুষ্ক প্রান্তরে ছেড়ে আপনি শামে চলে যান, তখন তিনি আবেদন করেছিলেন যে, তাদেরকে ফলমূল দান করুন; যদিও তা অন্য জায়গা থেকে আনা হয়। এ কারণেই মক্কা মুকাররামায় আজ পর্যন্ত চাষাবাদের তেমন ব্যবস্থা না থাকলেও সারা বিশ্বের ফলমূল এত অধিক পরিমাণে সেখানে পৌছে থাকে যে, অন্যান্য অনেক শহরেই সেগুলো পাওয়া দুস্কর।

[৩] এ আয়াতাংশ থেকে কেউ কেউ প্রমাণ নিতে চেষ্টা করেছেন যে, বায়তুল্লাহ শরীফের ভিত্তি ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর পূর্বে স্থাপিত হয়েছিল। কোন কোন মুফাসসির এ আয়াতের এবং বিভিন্ন বর্ণনার ভিত্তিতে বলেনঃ

সর্বপ্রথম আদম 'আলাইহিস সালাম বায়তুল্লাহ নিৰ্মাণ করেন। নূহের মহাপ্লাবনের পর ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে এই ভিত্তির উপরেই বায়তুল্লাহ পূননির্মাণের আদেশ দেয়া হয়। জিবরাঈল আলাইহিস সালাম প্রাচীন ভিত্তি দেখিয়ে দেন। [কুরতুবী] তবে সহীহ কোন দলীল সরাসরি এটা প্রমাণ করে না যে, ইবরাহীম আলাইহিসসালামের পূর্বে কেউ কা'বা ঘর বানিয়েছে। বিভিন্ন দুর্বল বর্ণনায় আদম আলাইহিসসালাম এবং পরবর্তী ধ্বংসপ্রাপ্ত কিছু জাতির

মক্কায় আসার কথা এসেছে, কিন্তু সেগুলো সহীহ হাদীসের বিপরীতে টিকে না। যেখানে সরাসরি সহীহ হাদীসে এসেছে যে, “প্রথম মাসজিদ বাইতুল্লাহিল হারাম তারপর বাইতুল মাকদিস, আর এ দুয়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান হলো চল্লিশ বছরের”। [দেখুনঃ মুসলিমঃ ৫২০] ইবরাহীম আলাইহিস সালাম নির্মিত এই প্রাচীর জাহেলিয়াত যুগে বিধ্বস্ত হয়ে গেলে কুরাইশরা তা নতুনভাবে নির্মান করে। এ নির্মাণকাজে আবু তালেবের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও নবুওয়তের পূর্বে অংশগ্রহণ করেন। [মুসলিমঃ ৩৪০] এতে বায়তুল্লাহর বিশেষণ (محرّم) উল্লেখ করা হয়েছে। এর অর্থ সম্মানিতও হতে পারে এবং সুরক্ষিতও। বায়তুল্লাহ শরীফের মধ্যে উভয় বিশেষণই বিদ্যমান। এটি যেমন চিরকাল সম্মানিত, তেমনি চিরকাল শক্রর কবল থেকে সুরক্ষিত। [কুরতুবী]

[৪] ইবরাহীম আলাইহিস সালাম দো'আর প্রারম্ভে পুত্র ও তার জননীর অসহায়তা ও দুর্দশা উল্লেখ করার পর সর্বপ্রথম সালাত কায়েমকারী করার দোআ করেন। ইবন জারীর বলেন, এখানে বায়তুল্লাহকে কেন হারাম বা সম্মানিত/সুরক্ষিত করা হয়েছে তার কারণ বর্ণনা করা হয়েছে আর সেটা হচ্ছে, যাতে মানুষ সেখানে সালাত আদায় করতে সমর্থ হয়। [তাবারী; ইবন কাসীর] তাছাড়া সালাত সবচেয়ে উত্তম ইবাদাত। [আল-বাহরুল মুহীত]এর দ্বারা দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় মঙ্গল সাধিত হয়। যে এ সালাত ঠিকভাবে কায়েম রাখতে পারবে সে দ্বীন কায়েম রাখতে পারবে। [সা'দী] এ থেকে বোঝা গেল যে, পিতা যদি সন্তানকে সালাতের অনুবতী করে দেয়, তবে এটাই সন্তানদের পক্ষে পিতার সর্ববৃহৎ সহানুভূতি ও হিতাকাংখা হবে।

[৫] (اَفْىِٕدَةً) শব্দটি (فؤاد) এর বহুবচন। এর অর্থ অন্তর। এখানে (اَفْىِٕدَةً) শব্দটি (نكرة) এবং তার সাথে (من) অব্যয় ব্যবহার করা হয়েছে, যা (تبعيض) ও (تقليل) এর অর্থে আসে। তাই অর্থ এই যে, কিছু সংখ্যক লোকের অন্তর তাদের দিকে আকৃষ্ট করে দিন। [কুরতুবী ফাতহুল কাদীর] কোন কোন তাফসীরবিদ বলেনঃ যদি এ দো’আয় কিছু সংখ্যক অর্থবোধক অব্যয় ব্যবহার করা না হত; তবে সারা বিশ্বের মুসলিম, অমুসলিম, ইয়াহুদী, নাসারা এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সব মানুষ মক্কায় ভীড় করত, যা তাদের জন্য কষ্টের কারণ হয়ে দাড়াত। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম দো'আয় বলেছেনঃ কিছু সংখ্যক লোকের অন্তর তাদের দিকে আকৃষ্ট করে দিন। যাতে করে শুধু মুসলিমরাই এখানে আসে। [ইবন কাসীর]

[৬] যাতে করে তারা এ ফল-মুল খেয়ে আপনার ইবাদতের জন্য শক্তি লাভ করতে পারে। ইবন কাসীরা আল্লাহ্ তা'আলা এ দোআ কবুল করেছেন। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,

“আমরা কি তাদেরকে এক নিরাপদ হারামে প্রতিষ্ঠিত করিনি, যেখানে সর্বপ্রকার ফলমূল আমদানী হয় আমাদের দেয়া রিযকস্বরূপ" [সূরা আল-কাসাস ৭৫]

এ দোআর প্রভাবেই মক্কা মুকাররামা কোন কৃষিপ্রধান অথবা শিল্পপ্রধান এলাকা না হওয়া সত্বেও সারা বিশ্বের দ্রব্যসামগ্রী এখানে প্রচুর পরিমাণে আমদানী হয়, যা বোধ হয় জগতের অন্য কোন বৃহত্তম শহরেও পাওয়া যায় না। এ দোআর বরকতেই সব যুগে সব ধরনের ফল, ফসল ও অন্যান্য জীবন ধারণ সামগ্রী সেখানে পৌঁছে থাকে। [কুরতুবী]

(৭) এতে ইঙ্গিত করেছেন যে, সন্তানদের জন্য আর্থিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দোআ এ কারণে করা হয়েছে, যাতে তারা কৃতজ্ঞ হয়ে কৃতজ্ঞতার সওয়াবও অর্জন করে। এভাবে সালাতের অনুবর্তিতা দ্বারা দোআ শুরু করে কৃতজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে শেষ করা হয়েছে। মাঝখানে আর্থিক সুখ-শান্তির প্রসঙ্গ আনা হয়েছে। এতে শিক্ষা রয়েছে যে, মুসলিমের এরূপই হওয়া উচিত। তার ক্রিয়াকর্ম, ধ্যান-ধারণার উপর আখেরাতের কল্যাণ চিন্তা প্রবল থাকা দরকার এবং সংসারের কাজ ততটুকুই করা উচিত, যতটুকু নেহায়েত প্রয়োজন।

Tafsir Bayaan Foundation

‘হে আমাদের রব, নিশ্চয় আমি আমার কিছু বংশধরদেরকে ফসলহীন উপত্যকায় তোমার পবিত্র ঘরের নিকট বসতি স্থাপন করালাম, হে আমাদের রব, যাতে তারা সালাত কায়েম করে। সুতরাং কিছু মানুষের হৃদয় আপনি তাদের দিকে ঝুঁকিয়ে দিন এবং তাদেরকে রিয্ক প্রদান করুন ফল-ফলাদি থেকে, আশা করা যায় তারা শুকরিয়া আদায় করবে’।

Muhiuddin Khan

হে আমাদের পালনকর্তা, আমি নিজের এক সন্তানকে তোমার পবিত্র গৃহের সন্নিকটে চাষাবাদহীন উপত্যকায় আবাদ করেছি; হে আমাদের পালনকর্তা, যাতে তারা নামায কায়েম রাখে। অতঃপর আপনি কিছু লোকের অন্তরকে তাদের প্রতি আকৃষ্ট করুন এবং তাদেরকে ফলাদি দ্বারা রুযী দান করুন, সম্ভবতঃ তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে

Zohurul Hoque

''আমার প্রভু! আমি নিশ্চয়ই আমার বংশধরদের কতককে বসবাস করালাম তোমার পবিত্র গৃহের নিকটে চাষ-বাসহীন উপত্যকায়, -- আমাদের প্রভু! যেন তারা নামায কায়েম করে, সেজন্যে কিছু লোকের মন তাদের প্রতি অনুরাগী বানিয়ে দাও, আর তাদের ফলফসল দিয়ে জীবিকা প্রদান করো, যেন তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।